বাবুল হক, মালদহ: ফি ভোটে ‘গনি মিথ’? বছর দশেক আগেও মালদহে ভোট হত প্রয়াত বরকত গনি খান চৌধুরির নামে। ২০১৪ সালে লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন গনি পরিবারের দুই সদস্য। মালদহ উত্তরে ভাগ্নি মৌসম নুর, মালদহ দক্ষিণে আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু)। দু’জনেই জিতেছিলেন কংগ্রেসের প্রতীকে। ২০১৯-এ দল বদলে ঘাসফুল প্রতীক নিয়ে উত্তর মালদহে বিজেপির কাছে মৌসম হেরে যান। মালদহ দক্ষিণে অবশ্য মাত্র ৮০০০ ভোটের ব্যবধানে বিজেপিকে পরাস্ত করে কোতোয়ালি পরিবারের মান রক্ষা করতে পেরেছিলেন ডালুবাবু। সেবারই ‘গনি মিথ’ কার্যত ফিকে হয়ে যায়। এবার কী হবে, তা নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে জেলার অন্দরে।
পঞ্চায়েত ভোটের নিরিখে তৃণমূল (TMC) ঝড়ে বছর পাঁচেক আগেই মিথ উধাও হয়ে গিয়েছিল বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে (Panchayat Election) জেলা থেকে কার্যত মুছে গিয়েছিল কংগ্রেস। বরকতের সাজানো বাগান তছনছ হয়ে সর্বত্রই ফুটেছিল ঘাসফুল। পাশাপাশি সেই ২০১৮-তেই বেশ কিছু পঞ্চায়েতে পদ্ম ফুটিয়ে কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে জেলায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে গেরুয়া শিবির। পরিসংখ্যান বলছে, গনি মিথ কার্যত ভেঙে খান খান হয়ে যায় একুশের বিধানসভা নির্বাচনে। কংগ্রেসের দর্প চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। আম ও আমসত্ত্ব দুটোই পান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)।
প্রয়াত বরকত গনি খান চৌধুরীর (Abu Barkat Ataur Ghani Khan Choudhury) বাগানে একুশে ফের ঘাসফুলের বন্যা! রাজনৈতিক মহলের অভিমত, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেই মালদহে (Maldah) গনি মিথের অবসান ঘটে। জেলার ১২টির মধ্যে আটটি বিধানসভা আসনে জয়লাভ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। বাকি চারটিতে জয়লাভ করে বিজেপি। কংগ্রেস কার্যত মুছে যায়। এককালের গনির গড় সুজাপুরে দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর পর ইতিহাস গড়ে তৃণমূল (TMC)। কংগ্রেস প্রার্থী ঈশা খান চৌধুরীকেও পরাজিত করে সুজাপুরে ইতিহাস গড়ে তৃণমূল। টানা অন্তত পঞ্চাশ বছর ধরে আসনটি কংগ্রেসের দখলে ছিল। এই কেন্দ্র থেকে জিতে প্রথম বিধায়ক হয়েছিলেন বরকত সাহেব। এই সুজাপুরের মানুষের ভোটেই একদা দিল্লির মসনদ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাঁর প্রয়াণের প্রায় ১৮ পরেও সুজাপুর অটুট ছিল।
গনির কোতোয়ালি ভবনের সদস্যরাই এই কেন্দ্র থেকে প্রত্যেকটি নির্বাচনে বিধায়ক (MLA) হয়ে আসছিলেন। গনির বোন রুবি নুর, রুবির প্রয়াণের পর তাঁর মেয়ে মৌসম নুর, তার পর গনির সুইজারল্যান্ড ফেরত ভাই আবু নাসের খান চৌধুরি (লেবু), গনির ভাইপো তথা ডালুর ছেলে ঈশা খান চৌধুরী সুজাপুরের বিধায়ক হন। কিন্তু একুশে সেই ‘মিথ’ তৃণমূল ঝড়ে খান খান হয়ে যায়। সত্যিই কি খতম হয়ে গিয়েছে ‘গনি-মিথ’? এই লোকসভা নির্বাচনে (Lok Sabha Election 2024) এমনই প্রশ্ন ফের মাথাচাড়া দিয়েছে। মালদহ উত্তর কেন্দ্রে এবার গনি পরিবারের কেউ প্রার্থী হননি। গনি মিথে ভরসা হারিয়ে কোতোয়ালি বাড়ির বাইরে থেকে হরিশ্চন্দ্রপুরের প্রাক্তন বিধায়ক মোস্তাক আলমকে প্রার্থী করেছে কংগ্রেস হাইকমান্ড।
উত্তরে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন প্রাক্তন আইপিএস, অভিনেতা প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় উনিশের জয়ী বিদায়ী সাংসদ খগেন মুর্মুর উপর ফের আস্থা রেখেছে বিজেপি। রাজনৈতিক মহলের আশঙ্কা, উত্তরে গনির নাম করে ভোট হয় না কখনও। ফ্যাক্টর আদিবাসী এবং সংখ্যালঘু ভোট। একদা ‘লাল দূর্গ’ বলে খ্যাত আদিবাসী অধ্যুষিত হবিবপুর, গাজোল ও মালদহ বিধানসভা এলাকা ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে ‘গেরুয়া’ আবরণে। বিজেপি এই আদিবাসী ভোটব্যাঙ্ক লক্ষ্মীর ভাণ্ডার-সহ রাজ্যের সামাজিক প্রকল্পগুলির ঠেলায় এবার অটুট রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। সাঁওতাল সমাজের জন্য চালু করা সরকারি প্রকল্পগুলি তৃণমূলের পক্ষে অনেকটাই সাড়া ফেলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। আদিবাসী এলাকায় বিজেপি-তৃণমূলের লড়াইয়ের মাঝে কংগ্রেসের দেখা মেলে না। এটাই ট্র্যাডিশন। বিজেপির মার্জিন কত থাকবে, সেটাই দেখার।
মালদহ উত্তর কেন্দ্রের বাকি এলাকাগুলি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। হরিশ্চন্দ্রপুর, চাঁচোল, রতুয়া ও মালতিপুর। এখানে আবার বিজেপি কোনও ফ্যাক্টর নয়। কংগ্রেস আর তৃণমূলের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি হয়ে থাকে। এই দুই দলের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট কেমন ভাগাভাগি হয়, সেটাই মূল ফ্যাক্টর। ভোট কাটাকুটি না হলেই বিজেপির (BJP) ক্ষতি। তা জানে গেরুয়া শিবিরও। অন্যদিকে, মালদহ দক্ষিণে অবশ্য গনি মিথের বিষয়টিই চর্চায় রয়েছে। বরকতের পরিবারের সদস্যদের কি আর মূল্য দিতে নারাজ ভোটাররা? সেই প্রশ্নেই আতঙ্ক কংগ্রেসের দিল্লির নেতাদের বলে মনে করছে তথ্যাভিজ্ঞ মহল। মিথ ফিকে ধরে নিয়েই কি চারবারের জয়ী সাংসদ আবু হাসেম ওরফে ডালুর মতো প্রবীণ রাজনীতিককে মালদহ দক্ষিণে প্রার্থী করেনি কংগ্রেস (Congress)? একুশের বিধানসভা নির্বাচনে ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত ঈশাকে দক্ষিণে প্রার্থী করা হয়েছে। ডালুর পরিবর্তে তাঁর ছেলে ঈশাকে কেন প্রার্থী, দলের অন্দরে তা নিয়ে আগে থেকেই গুঞ্জন চলছে।
প্রার্থী ঈশা খান চৌধুরীর দাবি, “মানুষের অন্তরে যতদিন বরকত সাহেব আছেন, ততদিন আমাদের ভোটও আছে।” পোস্টার, ব্যানারে গনির ছবি। কিন্তু গনির নাম ভাঙিয়ে আর কতদিন? পাল্টা প্রচার চালাচ্ছে তৃণমূল। মালদহ দক্ষিণে তৃণমূল প্রার্থী শাহনওয়াজ আলি রায়হানের সঙ্গেই এবার মুখোমুখি লড়াই বিজেপি প্রার্থী শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরীর, তা মনে করছে তথ্যাভিজ্ঞ মহল। তৃণমূলের প্রার্থী শাহনওয়াজের সমর্থনে লেখা পোস্টারে ডালু-ঈশাদের ‘নীরবতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
তবু গনির নামেই ভোট? কালিয়াচকের ষাটোর্ধ্ব জিয়াউর রহমান বলেন, “গনি খান চৌধুরী সম্পর্কে আজকের ছেলেমেয়েরা কিছুই জানে না। এটাই কংগ্রেসের সমস্যা। সব ধীরে ধীরে তৃণমূল হয়ে গিয়েছে।” আর তরুণ শিক্ষক আফজাল হোসেন বলেন, “প্রায় দশ শতাংশ বয়স্ক মানুষ আছেন যাঁরা এখনও গনি খান ছাড়া কিছুই বোঝেন না। তবে এলাকার উন্নয়ন আর কাজের কথা ভেবে যুব সমাজের একটা বড় অংশ গনি পরিবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।” রাজনৈতিক মহলের আশঙ্কা, এই কেন্দ্রেও মূল ফ্যাক্টর ভোট ভাগাভাগির অঙ্ক। কংগ্রেস আর তৃণমূলের ভোট কাটাকুটির খেলায় এবার কি বৈতরণী পার হয়ে যাবে বিজেপি? অপেক্ষা ৭ মে-র।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.