সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: একজন রাজনীতিবিদ হয়েও সর্বদা শিরোনামে। কখনও কারণে, কখনও অকারণে। আর একজনের রাজনীতিতে আগমন প্যারাসুটের মতো। উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন রাজনীতির ময়দানে। আরেকজন মাঠের লোক। পোড়খাওয়া রাজনীতিক। দীর্ঘদিন ধরে মাটি কামড়ে বাম রাজনীতি করছেন। রণক্ষেত্রের নাম কৃষ্ণনগর। আর তিন যোদ্ধার নাম মহুয়া মৈত্র (Mohua Moitra), অমৃতা রায় এবং এস এম শাদি।
প্রথম জন, একটা সময় ছিলেন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার। মার্কিন মুলুকে উচ্চশিক্ষার পরে আমেরিকাতেই চাকরি করতেন মহুয়া। নিউ ইয়র্কের পরে লন্ডনেও ছিলেন চাকরিসূত্রে। সেখান থেকে দেশে ফেরা রাজনীতি করার লক্ষ্যেই। প্রথমে যোগ দেন রাহুল গান্ধীর ‘আম আদমি কি সেনা’য়। তার পর পরিচয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) সঙ্গে। রাজ্যে বাম শাসনের অবসানের লক্ষ্যে যোগ দেন তৃণমূলে। রাজনৈতিক সাফল্য শুরু হয় ২০১৬ সালে করিমপুরের বিধায়ক হিসাবে। ২০১৯ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের টিকিট দেন। সেখান থেকে জিতে সংসদেও যান।
মহুয়ার মূল প্রতিপক্ষ বিজেপির অমৃতা রায় । এবার লোকসভায় মহুয়াকে হারাতে মরিয়া বিজেপি। কারণ তৃণমূলের সাংসদ সংসদে রীতিমতো ‘স্টার’। তাঁর ভাষণ শুনে পিলে চমকে যায় তাবড় তাবড় রাজনীতিবিদের। শুধু তাই নয়, শেষদিকে টাকার বদলে প্রশ্ন করার অভিযোগে মহুয়াকে যেভাবে সংসদ থেকে বের করা হল, তার পর মহুয়া ফের সংসদে গেলে, সেটা বিজেপির পক্ষে ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ হয়ে দাঁড়াবে। লড়াকু, দাপুটে নেত্রীকে হারাতে দলের কোনও স্থানীয় নেতার উপর ভরসা না রেখে ঐতিহাসিক কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির রানিমাকে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত নেয় গেরুয়া শিবির। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই (Narendra Modi) নাকি উদ্যোগী হয়েছিলেন তাঁকে প্রার্থী করতে। প্রার্থী ঘোষণার পরে মোদি ফোনও করেছিলেন অমৃতাকে। সেই কথোপকথন বিজেপির (BJP) উদ্যোগেই প্রকাশ্যে আসে। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া রাজনৈতিক পরামর্শই পাথেয় বিজেপির রানির।
লড়াইয়ের তৃতীয় চরিত্র আগের দিনের মতো ততটা গ্ল্যামারাস নন, তবে তিনিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সিপিএমের এস এম শাদি। ২০০৬ বিধানসভায় প্রথম লোকসভার লড়াইয়ে নামেন। সেবার নাকাশিপাড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি হারেন। ২০১১ সালের পরিবর্তনের ভোটে তিনি পলাশীপাড়া কেন্দ্রে জেতেন। তবে পরের দু’বার ওই কেন্দ্রে দাঁড়িয়েও সুবিধা করতে পারেননি। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রে ভালো ফল করে সিপিএম। সেটাকে হাতিয়ার করে লড়ছেন সাদি। তাছাড়া সংখ্যালঘু অধ্যুষিত আসনে একমাত্র গ্রহণযোগ্য মুখ তিনি। গ্ল্যামার না থাকলেও বাম রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্য মুখ সাদি। সংখ্যালঘু এলাকায় ভালো প্রভাব রয়েছে।
তিন প্রার্থীর প্রচারের ধরনও কমবেশি একই রকম। মহুয়া গোটা লোকসভা কেন্দ্র হাতের তালুর মতো চেনেন। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে প্রচার করেছেন তিনি। মানুষের সঙ্গে মিশে যান। গত লোকসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগর শহরে পিছিয়ে ছিলেন। শহরের পুর পরিষেবা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে। সেই ক্ষোভ মেটাতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ‘দিদিকে বলো’র ধাঁচে কর্মসূচি করেছেন। দলের সংগঠনের বাইরে মহুয়ার নিজস্ব টিমও কাজ করেছে কৃষ্ণনগরে। অমৃতা রায় মাটির রাজনীতিবিদ নন। তাঁর নামও ঘোষণা হয়েছে দেরিতে। তবু তিনি চেষ্টা করেছেন যতটা মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। রোড শো, পদযাত্রাও করেন। ছোটছোট সভা করেছেন। আবার বড় জনসভাও করেছেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বীই। মহুয়ার হয়ে মমতা সভা করেছেন দুবার। আবার কৃষ্ণনগরে মোদিও জোড়া সভা করেছেন। এস এম শাদিও অলিতে-গলিতে গিয়ে প্রচার করেছেন। তুলনায় বড় সভা করেননি তিনি।
কৃষ্ণনগর লোকসভায় সেই ২০০৯ থেকে জিতে আসছে তৃণমূল। দুবার জিতেছেন তাপস পাল। একবার মহুয়া। কিন্তু প্রতিবারই কমেছে ভোটের ব্যবধান। ২০১৯ সালে মহুয়ার জয়ের ব্যবধান ছিল ৬৩ হাজারের সামান্য বেশি। উনিশে তৃণমূল ভোট পায় ৪৫ শতাংশের কিছু বেশি ভোট। বিজেপির কল্যাণ চৌবে ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। বাম কংগ্রেসের মিলিত ভোট ছিল ১০ শতাংশের কিছু বেশি। উনিশে তৃণমূলের মূল ভরসার জায়গা ছিল চাপড়া, পলাশিপাড়া, নাকাশিপাড়া ও কালীগঞ্জ বিধানসভা। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বিধানসভাগুলিতে ভালো লিড পেয়েছেন কিন্তু এবার এই বিধানসভাগুলিতেও সমস্যা রয়েছে। পলাশিপাড়ার বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য এখন জেলে। তেহট্ট, চাপড়ায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রয়েছে। তাছাড়া পঞ্চায়েতে সংখ্যালঘু ভোটের একটা বড় অংশে ভাগ বসিয়েছে সিপিএম। সংখ্যালঘু মুখ শাদি এবারও যদি সংখ্যালঘু ভোটে ভাগ বসান, তাহলে চাপে পড়তে হতে পারে শাসককে। আবার বিজেপিও স্বস্তিতে নেই। গতবার কৃষ্ণনগর শহরের যে দুই কেন্দ্র গেরুয়া শিবিরকে লড়াইয়ে রেখেছিল, সেই দুই কেন্দ্রে প্রচুর খেটেছে শাসকদল। সব মিলিয়ে কৃষ্ণনগরে ব্যাঙ্কার, রানিমা আর পোড়খাওয়া সমাজসেবীর লড়াই বেশ জমজমাট।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.