সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: রং বদল। দোলের দিন ভেষজ, নিরীহ রং ভেবে যা গায়ে মাখলেন, কিংবা রঙিন আবির ভেবে আলতো করে যেটা লাগিয়ে নিলেন গালে, পরে দেখা গেল সেটা তুলতে গিয়েই কালঘাম ছুটছে। দেখা গেল ওই ‘নিরীহ’ ভেষজ আবিরেই মেশানো ক্ষতিকর জেদি কেমিক্যাল। কিংবা সবুজ ভেবে যে রং মাখলেন, তাতেই মেশানো লাল বা গেরুয়া। দোলের দিন এই রং বদলের ‘শিকার’ হয়েছেন অনেকেই। ইদানিং রাজনীতির রঙ্গমঞ্চেও এই রংবদলের শিকার হচ্ছে বহু দল। এবং অবশ্যই শিকার হচ্ছেন আমজনতা।
দোল এবং দল। রংবাজি এবং দলবাজি। ভরা বসন্তে এই দুই-ই সমানতালে চলছে বঙ্গ রাজনীতিতে। উপলক্ষ্য হোলি এবং ভোট (Lok Sabha 2024)। ভোটের মরশুমে দোল যেন উৎসবে অন্য মাত্রা যোগ করে। কার গায়ে কোন রং, কোন রঙের কী তাৎপর্য। এই নিয়ে যাবতীয় আলোচনা। তবে সব চেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে কার গায়ের রং কখন বদলে গেল, আর সেই রং বদলে কে কতটা ফায়দা পেলেন, তাই নিয়ে। এমনই সব ‘গিরগিটি’দের রংবদলের ইতিহাস একটু ঘেঁটে দেখা যাক।
অর্জুন সিং: বঙ্গ রাজনীতিতে অর্জুন সিংয়ের (Arjun Singh) মতো রংবদলের নজির সাম্প্রতিক অতীতে আর কোনও নেতা দেখাতে পারেননি। এই তিনি নীল সাদা আবার এই গেরুয়া। এমনিতে অর্জুনের রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘ। তবে এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে রংবদলের নজিরও কম গড়েননি অর্জুন। অর্জুনের বাবা ছিলেন দাপুটে কংগ্রেস নেতা। তিনি নিজেও নয়ের দশকের মাঝামাঝি কংগ্রেসের টিকিটে কাউন্সিলর হন। পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুসরণ করে যোগ দেন তৃণমূলে। প্রায় দু দশক অর্জুন তৃণমূলে ছিলেন। এর মধ্যে একাধিকবার বিধায়ক হয়েছেন। রাজ্যের মন্ত্রীও হয়েছেন। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে টিকিট না পেয়ে যোগ দেন বিজেপিতে। তৃণমূল অবশ্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অর্জুনকে আটকে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। সাংসদ হয়ে ‘জনসেবা’ করার আকাঙ্ক্ষায় বিজেপির টিকিটে বারাকপুর থেকে ভোটে লড়েন অর্জুন। জিতেও যান। কিন্তু বিজেপিতেও বেশিদিন টিকতে পারেননি তিনি। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের বছরখানেক বাদে ফের তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি। আশা ছিল চব্বিশে অন্তত লোকসভার টিকিট দেবে তৃণমূল। শাসকদল ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে বারাকপুরের প্রার্থী হিসাবে পার্থ ভৌমিকের নাম ঘোষণা করার পরই ফের তৃণমূল ছাড়েন তিনি। আবারও চলে যান সেই বিজেপিতে। গেরুয়া শিবির ফের তাঁকে বারাকপুরের প্রার্থী করেছে। এখন দেখার ভোটের পর অর্জুন গেরুয়াই থাকেন নাকি ফের রংবদল, থুড়ি দলবদল করেন।
বিশ্বজিৎ দাস: দলবদলের নিরিখ অর্জুনের থেকে কোনও অংশে কম যান না বনগাঁর তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস। বিশ্বজিৎ (Bishwajit Das) নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ার শুরু করেন তৃণমূল থেকে। দীর্ঘদিন দল করার পর উনিশের লোকসভা নির্বাচনের আগে হয়তো লোকসভার টিকিটের আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু সে আশায় জল ঢেলে উনিশে বনগাঁ থেকে মমতা ঠাকুরকে প্রার্থী করে তৃণমূল। বিশ্বজিৎ দলবদল করে চলে যান বিজেপিতে। ২০২১-এ বিজেপির টিকিটেই বিধায়ক হন। কিন্তু তাঁর ‘হৃদয়ে’ নাকি তখনও ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভা ভোট মেটার কয়েক মাসের মধ্যেই তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন বিশ্বজিতের। খাতায়-কলমে এখনও বিজেপির বিধায়ক হলেও চব্বিশের ভোটে বনগাঁ থেকে বিশ্বজিৎকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল।
কৃষ্ণ কল্যাণী: রায়গঞ্জের কৃষ্ণ কল্যাণী (Krishna Kalyani) আদপে ব্যবসায়ী। রাজনীতিতে তিনি নিতান্তই নবাগত। তবে নবাগত হলেও দলবদলে ইতিমধ্যেই হাত পাকিয়ে ফেলেছেন তিনি। একুশের বিধানসভার আগেই বিজেপিতে যোগ দেন তিনি। বিধানসভায় বিজেপির টিকিটে লড়ে বিধায়কও হন। কিন্তু সে বছর অক্টোবরেই যোগ দেন তৃণমূলে। নিন্দুকেরা বলেন, নিজের ব্যবসাপাতি নির্বিঘ্নে চালাতেই শাসকদলের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতে হয় কৃষ্ণকে। তাঁকে বিধানসভায় পিএসির চেয়ারম্যানও করে দেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই কৃষ্ণ কল্যাণীকে এবার লোকসভায় টিকিট দিয়েছে তৃণমূল। মজার কথা হল, বিশ্বজিতের মতো কৃষ্ণ কল্যাণীও খাতা-কলমে বিজেপির বিধায়ক।
মুকুটমণি অধিকারী: মুকুটমণি অধিকারী (Mukut Mani Adhikari) পেশায় চিকিৎসক। তাঁর নামটা বঙ্গ রাজনীতির আঙিনায় প্রথমবার ভেসে ওঠে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের সময়। বিজেপি রানাঘাট কেন্দ্রের প্রার্থী হিসাবে প্রথমে মুকুটমণির নামই ঘোষণা করে। কিন্তু তখনও তিনি রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরের চাকুরে। অভিযোগ, সেসময় ইচ্ছাকৃতভাবে মুকুটমণিকে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র দেয়নি রাজ্য সরকার। অগত্যা রানাঘাট কেন্দ্র থেকে লোকসভায় বিজেপির প্রার্থী হন জগন্নাথ সরকার। এবং তিনি জিতেও যান। পরে রানাঘাট দক্ষিণ কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে বিধায়ক হন মুকুটমণি। তাঁর আশা ছিল চব্বিশে তাঁকে রানাঘাট থেকে প্রার্থী করবে দল। কিন্তু গেরুয়া শিবির দলের বিদায়ী সাংসদকেই ফের টিকিট দিয়েছে। সম্ভবত সেই ক্ষোভ থেকেই মুকুটমণি যোগ দেন তৃণমূলে। রাজ্যের শাসকদল তাঁকে রানাঘাট থেকেই প্রার্থী করেছে। তিনিও খাতায় কলমে বিজেপির বিধায়ক। মুকুটমণির তৃণমূলে যোগের আরও একটা কারণ কোনও কোনও মহলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আসলে বিজেপিতে থাকাকালীন মুকুটমণির বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য হিংসার মতো মারাত্মক অভিযোগ উঠেছিল। রাজ্য পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তও শুরু করেছিল। নিন্দুকেরা বলেন, মুকুটের তৃণমূল যোগে হঠাৎ করেই তদন্তের গতি খানিক হ্রাস পেয়েছে।
সৌমেন্দু অধিকারী: শান্তিকুঞ্জের কনিষ্ঠতম রাজনৈতিক সদস্য। এ পর্যন্ত রাজনীতিতে যা যা অর্জন করেছেন অধিকাংশই বাবা শিশির অধিকারী এবং দাদা শুভেন্দু অধিকারীর দৌলতেই। সৌমেন্দু অধিকারী (Soumendu Adhikari) শুরু থেকেই তৃণমূলের সদস্য। শাসকদলের হয়ে কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যানের আসনেও বসেন। কিন্তু একুশে দাদা শুভেন্দু অধিকারীর পথ অনুসরণ করে বিজেপিতে যোগ দেন। পারিবারিক সূত্রে তাঁর রাজনীতিতে আগমন আবার পারিবারিক সূত্রেই রংবদল। গত কয়েক বছর তিনি বিজেপিই করছেন। এবার তাঁকে পারিবারিক আসন কাঁথি থেকেই লোকসভার প্রার্থী করেছে বিজেপি।
তাপস রায়: এই তালিকায় সবচেয়ে প্রবীণ এবং সম্ভবত সবচেয়ে চমকপ্রদ নাম। আজন্ম কংগ্রেসি ঘরানার রাজনীতি করা তাপস রায় (Tapas Roy) এখন বিজেপিতে। তাপস রায় সেই ছাত্র পরিষদের সময় থেকে মুখ্যমন্ত্রীর অনুগামী। অনেকে বলেন, তৃণমূলের ‘বঞ্চিত’ নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। মমতার একনিষ্ঠ অনুগামী তাপস তৃণমূলের সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে কাজ করলেও প্রথমবার সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ২০১৬ সালে। তাও তাঁর কর্মভূমি উত্তর কলকাতা থেকে অনেকটাই দূরের বরানগর কেন্দ্রের বিধায়ক হিসাবে। ২০২১-এ ফের বিধায়ক হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে মন্ত্রী করা হয়নি। বদলে ছুটকো-ছাটকা পদ দেওয়া হয়। মাঝে কিছুদিন উত্তর কলকাতা জেলা তৃণমূলের সভাপতি করা হলেও সে পদেও বেশিদিন রাখা হয়নি। দল বরাবর তাঁর চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে উত্তর কলকাতার আরেক প্রবীণ নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তৃণমূলের প্রতি তাপসের বিতৃষ্ণার সেটাই প্রধান কারণ। শেষমেশ চব্বিশের লোকসভার একেবারে আগেভাগে একরাশ অভিমান নিয়ে তৃণমূল ছাড়েন তাপস। যোগ দেন বিজেপিতে (BJP)। তিনি ইস্তফা দিয়েছেন বিধায়ক পদ থেকেও। তাপসকে উত্তর কলকাতা থেকে সুদীপের বিরুদ্ধেই প্রার্থী করেছে বিজেপি। প্রশ্ন হল, যে লোকটা আজীবন কংগ্রেসি রাজনীতি করে গেলেন, রাজনৈতিক জীবনের শেষদিকে এসে সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শে বিশ্বাসী একটি দলে টিকবেন তো? নাকি গেরুয়া থেকে ফের রংবদল করতে বেশিদিন সময় লাগবে না তাঁর?
উপরে যে কয়েকজনকে নিয়ে আলোচনা করা হল, রংবদলের তালিকাটা তাঁদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বঙ্গ রাজনীতিতে এই রংবদলের প্রবণতা ইদানিং নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রতিদিনই রাজ্যের কোনও না কোনও প্রান্তে কোনও না কোনও স্তরের নেতা কোনও না কোনও দল থেকে কোনও না কোনও দলে যোগ দিচ্ছেন। রং বদলাচ্ছে রাজনীতি, রং বদলাচ্ছেন নেতারা। আর এই হাজার রঙের মাঝে কোনও না কোনও ভাবে উপেক্ষিত গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, আমজমতা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.