গৌতম ব্রহ্ম: পরিযায়ী পঙ্গপাল!
সুদূর ‘হর্ন অফ আফ্রিকা’ থেকে বালুচিস্তান হয়ে ভারতের রাজস্থান। ছোট্ট পাখায় ভর করেই দল বেঁধে কয়েক হাজার মাইল পথ পাড়ি। ভয়ংকর হয়ে ওঠা পতঙ্গের পাল জয়পুরে তাণ্ডব চালিয়ে ঢুকে পড়েছে মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশেও। হোয়াট নেক্সট? গো বলয়ের পর পঙ্গপাল বাহিনী নাকি বাতাসের গতিপথ বেয়ে পূর্ব দিকে সরতে শুরু করেছে। ঝড়খণ্ড পর্যন্ত নাকি চলেও এসেছে! তবে, কি পঙ্গপালদের পরবর্তী গন্তব্য গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ?
চিন্তায় আকুল বাংলার পতঙ্গবিদরা। কারণ, এই অ্যাক্রিডিডেই প্রজাতির এই পঙ্গপালের প্রজননের জন্য যে অনুকূল পরিবেশ দরকার, তা এখন আমফানের সৌজন্যে পশ্চিমবঙ্গে মজুত। সুতরাং বাংলার ভিজে মাটি, গঙ্গাপাড়ের হাওয়া, মাঠভরতি ফসল, সব মিলিয়ে সুজলা-সুফলা বাংলা ‘অটোমেটিক চয়েস’ হতেই পারে। এমনটাই মনে করছেন বিশিষ্ট পতঙ্গবিদরা। তাঁদের মত, এই পরিযায়ী পতঙ্গ বাহিনী যে গতিতে উড়ছে তাতে বাংলা কেন, ভারতের যে কোনও রাজ্যে এরা পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। সুতরাং সাবধান হওয়াই ভাল।
প্রশাসনও বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে। রাজ্যের পতঙ্গবিদরা পঙ্গপালের গতিবিধির উপর নজর রাখছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, ’৬১ সালে কলকাতায় একবার পঙ্গপাল হানা দিয়েছিল। ঝাঁকে ঝাঁকে পতঙ্গের দল মেঘের মতো কালো হয়ে প্লেনের মতো ভোঁ ভোঁ শব্দ করতে করতে মহানগরে ঢুকেছিল। আর তেমন কোনও তথ্য নেই। তাই, এদের সামলানোর জন্য পর্যাপ্ত হোমওয়ার্ক চাই। যা করোনা ও আমফান বিধ্বস্ত বাংলার প্রশাসনের পক্ষে বেশ মুশকিল। তাই, দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম উড়েছে বাংলার কৃষকদের। রাজস্থানের জয়পুরের মতো এখানেও যদি হানা দেয় পঙ্গপাল! নষ্ট করে ফেলে ফসল! সিঁদুরে মেঘ দেখছে জঙ্গলমহল। কারণ, ঝাড়খণ্ড থেকে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর হয়েই ঢোকার কথা এই পরিয়াযীদের। সেক্ষেত্রে বিঘের পর বিঘে ছিবড়ে করে ফেলবে। এমনটাই মনে করছেন নবীন পতঙ্গবিদ অর্ণব চক্রবর্তী।
তাঁর বক্তব্য, আফ্রিকা থেকে যখন যাত্রা শুরু করেছিল পঙ্গপালের দলটি, তখন কিন্তু সংখ্যায় এত বড় ছিল না। আস্তে আস্তে বেড়েছে। এরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বংশবিস্তার করতে পারে। এক একটি পঙ্গপাল একশোটি পঙ্গপালের জন্ম দিতে পারে। সুতরাং হাজার থেকে লাখে পৌঁছতে মাত্র কয়েকদিন সময় লাগে। অর্ণব আরও জানান, এদের পাঁচ-ছয় রকমের প্রজাতি রয়েছে। এরা মূলত তুলো ও সবজিখেতে হামলা চালায়। একসঙ্গে কয়েক লক্ষ থাকে। এদের সামলানো সত্যিই মুশকিল। ভ্যাকুম ক্লিনারের মতো ‘অ্যাসপিরেটর’ ব্যবহার করে এদের বন্দি করা যেতে পারে। অনেক দেশ ‘নালিজ ট্র্যাপ’ ব্যবহার করে। তবে, প্রথমে কীটাণুনাশক ব্যবহার না করাই ভাল। ‘মেকানিক্যাল পদ্ধতি’ ব্যবহার করে বরং এই পরিযায়ীদের ‘কোয়ারান্টাইন’ করা অনেক বুদ্ধিমানের কাজ!
করোনা আবহে লকডাউনের জেরে এমনিতেই দেশের অর্থনীতি বেহাল। তার উপর এবার পঙ্গপালের উপদ্রব। ফলে বেজায় চিন্তায় চাষিরা। এমনিতেই রাজস্থানের কৃষকদের অবস্থা সঙ্গীন। এবার তাঁদের কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিচ্ছে এই রাক্ষুসে পোকার দল। রাজস্থানের জয়পুরে অন্তত পাঁচ লক্ষ হেক্টর জমির ফসল পঙ্গপালের দাপটে শেষ হয়ে গিয়েছে। কার্যত সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছেন চাষিরা।
সোমবার জয়পুরের বাসিন্দারা এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। আকাশ কালো করে খেতের উপর আছড়ে পড়ে লক্ষ লক্ষ পঙ্গপাল। পাকিস্তান থেকে সেগুলি এ দেশে ঢুকেছে। ইতিমধ্যেই একাধিক রাজ্যে ফসলের উপর তাদের নজর পড়েছে। ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে পঙ্গপালের তাণ্ডবে প্রচুর ক্ষতি হওয়ায় সেখানে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছিল। ভারতেও মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশে ঢুকে পড়েছে পঙ্গপালের ঝাঁক। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে রাজস্থানে। কৃষকদের দৈনন্দিন জীবিকা অর্জনের ন্যূনতম পথও বন্ধ। বিশেষত পূর্ব ও পশ্চিম রাজস্থানে। পশ্চিম রাজস্থানের শ্রীগঙ্গানগর, বিকানের, আজমেরে রবিশস্যের খেত উজাড় করে দিয়েছে গোলাপি মরু পঙ্গপালের দল। রাসায়নিক স্প্রে করেও তাদের বাগে আনা যায়নি। যশকরণ সিং নামের এক কৃষক বলছেন, “মায়ের নামে ৯ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। এখন শস্য শেষ, আমিও শেষ হয়ে গিয়েছি। কীভাবে ঋণের টাকা শোধ করব ভেবেই পাচ্ছি না।” এখন সরকারি সাহায্যের আশায় তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। উল্লেখ্য, চলতি মাসের গোড়ায় পঙ্গপালের তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির জের সামলাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাহায্য চেয়েছেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.