সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: সেই ফুটফুটে ছোট্ট চিতাবাঘের শাবক এখন ‘সাব অ্যাডাল্ট’। বয়স এক বছরের চেয়ে কিছু বেশি। আর সেই চিতাবাঘকেই পুরুলিয়ার ‘রেসিডেন্সিয়াল’ তকমা দিল রাজ্যের বনবিভাগ। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া জঙ্গলমহলের এই জেলায় চিতাবাঘকে ‘রেসিডেন্সিয়ালে’র তকমা এই প্রথম। আর তাই বোধহয় আট বছর আগে ২০১৫ সালের ২০ জুন টাটুয়াড়া গ্রামে পূর্ণবয়স্ক চিতাবাঘকে পিটিয়ে মারার ‘কলঙ্ক’ ঘুচল কোটশিলায়! বনদপ্তরের ট্র্যাপ ক্যামেরায় ধরা দিলো হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওই কোটশিলা বনাঞ্চলের সিমনি বিটের হরতানের বাঁশ জঙ্গলে। রাজ্যের প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) তথা ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেন দেবল রায় বলেন, “ওই চিতাবাঘের শাবক এখন ‘সাব অ্যাডাল্ট’ হয়ে পুরুলিয়ার রেসিডেন্সিয়াল।”
রাজ্যের বন বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়েক দশক আগে একটি চিতাবাঘ অযোধ্যা পাহাড়ের জঙ্গলে ছিল। কিন্তু সেই বন্যপ্রাণকে পুরুলিয়া ও ঝাড়খণ্ড দু’জায়গারই ‘বাসিন্দা’ হিসাবে ধরা হত। এবার এই চিতাবাঘ শুধুমাত্র পুরুলিয়ার বনদপ্তরের খাতায় তালিকাভুক্ত হল। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত কোটশিলার এই সিমনি বিটে বনদপ্তরের ট্র্যাপ ক্যামেরায় একাধিকবার ধরা পড়ে পুরুষ চিতাবাঘ। যাকে ‘মাইগ্রেন্ট’ বা ‘অভিবাসী’ বললেও ওই জোড়া পুরুষ ও মাদি চিতা এই সিমনির জঙ্গলে গত বছর বর্ষায় শাবকের জন্ম দেয়। সেই সঙ্গে এই জঙ্গলেই ওই শাবক বড় হয়ে ওঠায় তাকে স্থায়ী বাসিন্দা বলছে রাজ্যের বনবিভাগ।
উত্তরবঙ্গে যখন মানুষ-চিতা বাঘের সংঘাত বাঁধছে প্রায় রোজ। তখন বনমহল পুরুলিয়ায় ঠিক উলটো ছবি। চিতাবাঘের ঘর সংসারকে যেন বছর বছর আগলে রেখেছেন কোটশিলা বনাঞ্চলের সিমনি বিটের বাসিন্দারা। জাবর, সিমনি, হরতান, রিগিদ, কাড়িয়ড় পাহাড়-জঙ্গলে ঢাকা এই বিস্তীর্ণ গ্রামগুলিতে গত তিন বছর ধরে একাধিক চিতাবাঘ দু’ডজনের বেশি গবাদি পশুকে মেরে দিয়েছে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ চেয়ে একটি আবেদনপত্রও জমা পড়েনি সিমনি বিটের কার্যালয়ে। ঝাড়খণ্ড ছুঁয়ে থাকা এই বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষজন বলছেন, বন্যপ্রাণ থাকলে জঙ্গল সমৃদ্ধ হবে। চিতাবাঘের সংখ্যা আরও বাড়ুক সিমনি বিটের জঙ্গলে। তাই বনজ সম্পদ সংগ্রহে পেট চালানোর বিষয় থাকলেও ওই ঘন জঙ্গলে এখন আর কেউ পা রাখেন না। ওই জঙ্গল এখন চিতাবাঘের ঘর-সংসারের একেবারে নিশ্চিন্ত, নিরাপদ আশ্রয়।
ওই এলাকার মানুষজনের এমন আচরণে খুশি রাজ্যের বনবিভাগও। রাজ্যের বন বিভাগের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “বনদপ্তরের পাশাপাশি ওই এলাকার যৌথ বন পরিচালন সমিতিকে বলব তারা যাতে ওই জঙ্গল ভালভাবে রক্ষা করেন। তাহলে বন্যপ্রাণ আরও বাড়বে। এটা একটা ভাল দিক কোটশিলায় চিতাবাঘ-মানুষে কোন সংঘাত বাঁধছে না। মহারাষ্ট্রে, গুজরাটে, উত্তরপ্রদেশে বন্যপ্রাণকে পিটিয়ে মারা হয়। আর বাংলায় বনদপ্তরের ধারাবাহিক সচেতনতার প্রচারে মানুষজন বন্যপ্রাণকে রক্ষা করেন।” সিমনির বাসিন্দা পরেশ হেমব্রম, আনন্দ মুর্মু বলেন “এই জঙ্গলে থাকা চিতাবাঘকে আগেই দেখেছি। তবে বাচ্চাটাকে এখনও দেখিনি। ওরা থাকুক এখানে। কিন্তু মাঝেমধ্যে গরু-মহিষ মেরে দিলে খারাপ লাগে এই যা। তবে বন্যপ্রাণ থাকলে জঙ্গল আরও ভাল হবে। সেই জন্য আমরা আর ওই ঘন জঙ্গলে যাই না।”
তবুও পুরুলিয়া বনবিভাগ ভীষণই সতর্ক। ওই চিতাবাঘের শাবকের বড় হয়ে যাওয়ার ছবি প্রায় মাসছয়েক আগে বনদপ্তরের হাতে এলেও তা সামনে আনেনি ওই বন্যপ্রাণের সুরক্ষার কথা ভেবে। কারণ, সিমনির জঙ্গল ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। তাই ভীষণই সাবধানতা অবলম্বন করছে বনদপ্তর। কারণ, ওই ‘সাব অ্যাডাল্ট’ চিতাবাঘ এখনও শিকারে দক্ষ হয়েছে কিনা তা বুঝতে পারছে না বনদপ্তর। এই ধরনের বন্যপ্রাণের টেরিটোরিয়াল ও হোম রেঞ্জ থাকে। টেরিটোরিয়াল রেঞ্জ বলতে যে এলাকায় তার বসবাস। সেখানে তার সমতুল কোন বন্যপ্রাণকে আসতে দেয় না। আর হোম রেঞ্জ এলাকায় সে শিকার করে। বনদপ্তরের কথায়, দু’বছর হলে চিতাবাঘকে পূর্ণবয়স্ক বলা যায়। কিন্তু ‘ব্রিডিং অ্যাডাল্ট’ তিন বছরের আগে নয়।
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.