যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, খড়গপুর আইআইটি হয়ে ইসরোর বিজ্ঞানী। চন্দ্রযানের সফল উৎক্ষেপণের পর কেমন অনুভূতি? কলম ধরলেন উত্তর ২৪ পরগনার বাঙালি বিজ্ঞানী রাজীব সাহা।
ইসরো থেকে যখন কোনও জিএসএলভির উৎক্ষেপণ হয়, ভিডিওয় সেটা দেখে খুব ভাল লাগে। ওখানে আমার হাতের স্পর্শ আছে ভাবলেই অদ্ভুত তৃপ্তি হয়। শ্রীহরিকোটায় আমার চোখের সামনে দিয়েই চাঁদের দক্ষিণ মেরুর উদ্দেশে উড়ে গিয়েছিল চন্দ্রযান ৩। আর বুধবার যখন পৌঁছে গেল তখন আমি খড়্গপুর আইআইটিতে বসে। চন্দ্রযান ৩-এর প্রোপালশন ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম। উৎক্ষেপণের সময়ে ইঞ্জিন থেকে যাতে ‘থ্রাশ’ পাওয়া যায় এবং রকেটটি সঠিক গতিতে এগিয়ে সেই সংক্রান্ত সব কিছু দেখার দায়িত্ব ছিল।
এই ঐতিহাসিক অভিযানের কাণ্ডারি হতে পেরে গর্ব হচ্ছে খুব। আসলে ইসরোয় পৌঁছনো আমার মতো পরিবারের ছেলের জন্য একদমই সহজ ছিল না। আমরা না খুব গরিব ছিলাম। আগরপাড়ার নেতাজি সুভাষ স্কুল থেকে মাধ্যমিক দেওয়ার পর মনে হয়েছিল পড়াশোনা ছেড়েই দিতে হবে। মাধ্যমিকের পরে তিন মাস সবাই যখন ঘুরতে যাচ্ছে, কম্পিউটার কোর্স করছে তখন বাবার সঙ্গে আমি ডানলপের কাছে সরস্বতী প্রেসে কাজ করতে গেলাম। ১৫-১৬ বছরের ছেলে বলে ওরা কাজে নিতে চাইছিল না। বাবার অনেক অনুরোধে রাজি হয়ে গেল। মনে আছে, সকাল সাড়ে আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করে রোজ ৩০ টাকা করে পেতাম। এরপর মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরল। স্কুলে ফার্স্ট হলাম। আমার মেন্টর-স্যর সুভাষদা বললেন, ‘পড়াশোনা ছাড়িস না। আমরা হেল্প করব।’
২০০৭-এ উচ্চমাধ্যমিক পাশ করি আগরপাড়ার উষুমপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার প্রস্তুতি বা জয়েন্ট পরীক্ষা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তাই রামকৃষ্ণ মিশন শিল্পপীঠ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করি। ওখান থেকে মাসিক আট-ন’হাজার টাকার বেতনে একটা ছোট্ট কোম্পানিতে চাকরি পাই। সেখানে কাজ করতে করতে শুরু করি ওয়েস্ট বেঙ্গল জিলেট পরীক্ষার প্রস্তুতি। তাতে রাজে্য প্রথম হই। চান্স পেয়ে গেলাম যাদবপুরের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ওখানে জিলেট পাস ছেলেমেয়েদের জন্য দু’টি সিট রাখা থাকে। তার মধ্যে আবার রিজার্ভেশন সিটও থাকে। তাই ফার্স্ট হওয়াটা খুব দরকার ছিল।
যাদবপুরে ঢুকে জীবনের নতুন একটা অধ্যায় খুলে যায়। ওখান থেকে ক্যাম্পাসিংয়ে দিল্লিতে একটা কোম্পানিতে কাজ পাই। দু’বছর কাজের পর মনে হচ্ছিল, কিছু যেন একটা মিস করছিলাম। কাজটা করে ঠিক আনন্দ পাচ্ছিলাম না। একদিন অফিসে গিয়ে ইস্তফা দিয়ে দিলাম। বাড়ি ফিরে গেট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। গেটের সিলেবাসের সঙ্গে ইসরোর পরীক্ষার সিলেবাস অনেকটাই এক। তাই ওখানকার পরীক্ষায় বসি। র্যাঙ্ক হয় ২১।
এমনিতে কেরলে ত্রিবান্দ্রমের বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারে আমার কাজ। তবে জিএসএলভি উৎক্ষেপণের আগের দু’-আড়াই মাস লঞ্চ সেন্টারে চলে যেতে হয়। শ্রীহরিকোটা আমার দ্বিতীয় বাড়ি। সকাল ন’টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ইসরোর বিজ্ঞানীদের কাজ করতে হয়। তবে প্রজেক্ট গুরুত্বপূর্ণ হলে বা উৎক্ষেপণের দিন এগিয়ে এলে সারা দিনরাত কাজ করতে হতে পারে। আমার স্ত্রী আর্মিতে। কলকাতায় থাকেন। দু’জনে একসঙ্গে ছুটি নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরতে যাওয়াটাই এখন নেশা।
ভালবাসি মাছ, ভাত খেতে। তবে কাজের দিনগুলোয় ইসরোর ক্যান্টিনেই দক্ষিণী খাবার খাই। অসুবিধা হয় না। নিজে নানা পদ রাঁধতেও পারি। ইসরোয় কাজের চ্যালেঞ্জ, নিজেকে ভেঙে গড়ার সুযোগ আমাকে আর কোনও কোম্পানি হয়তো দিত না। ইসরো থেকে আমাকে সম্প্রতি আইআইটি খড়্গপুরে মেকানিক্যাল সিস্টেম ডিজাইন বিষয়ে এম.টেক করতে পাঠিয়েছে। এর সঙ্গে পিএইচডিও করার ইচ্ছা যাতে ইসরোর আরও লাভ হয়। ইসরোর কাজে লাগবে এবং আমার আগ্রহ আছে এমন বিষয়ে পিএইচডি করব।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.