সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ‘সাঁইবাড়ির ঘটনায় লাল সেলাম! আরও হাজার হাজার সাঁইবাড়ি হোক!’ সাঁইবাড়ির ‘রক্তমাখা’ ইতিহাসকে সোশাল মিডিয়ায় গরিমান্বিত করছে সিপিএমের জনৈক সমর্থক। অথচ তারাই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সরব হচ্ছে। অভয়ার বিচার চাইছে। বাম সমর্থকদের এই দ্বিচারিতাকে নিশানা করেছেন তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘এরাই সিপিএম। চিনে রাখুন।’
সোমবার সাঁইবাড়ির ৫৫ বছর। স্বাভাবিকভাবেই সোশাল মিডিয়ায় গুচ্ছ গুচ্ছ পোস্ট করা হয়েছে। কেউ তার স্বপক্ষে কেউ তার বিপক্ষে। এমনই জনৈক সিপিএম সমর্থকের এক্স হ্যান্ডেলের পোস্ট তুলে ধরেছেন কুণাল। তাঁর শেয়ার করা পোস্টে সাঁইবাড়ির ‘মাস্টার মাইন্ড’ বিনয় কোঙারের ছবি। সঙ্গে লেখা হয়েছে, ‘সাঁইবাড়ির ঘটনায় লাল সেলাম! কমরেড ৫৫ বছর আগে তুমি যা করেছিলে বেশ করেছিলে!! আরো হাজার হাজার সাঁইবাড়ি হোক!!’ এই পোস্ট শেয়ার করে কুণাল লেখেন, ‘এই হল সিপিএম। চিনে রাখুন। হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত বিনয় কোনারের ছবি দিয়ে পোস্ট: আরও সাঁইবাড়ি হোক।’ রাজনৈতিক কারবারিদের অভিযোগ, ক্ষমতায় ফিরতে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে বলে সোশাল মিডিয়ায় ‘গেল গেল’ রব তুলেছে বামেরা। আবার ‘মাকে সন্তানের রক্তমাখা ভাত খাওয়ানো’ সেই বামেরাই আজ অভয়ার সুবিচার চাইছে। তারাই আবার ‘আরও সাঁইবাড়ি হোক’ বলে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করছে। এই পোস্টই বামেদের দ্বিচারিতা প্রমাণ করে দিয়েছে বলে মত রাজনৈতিক মহলের।
এই হল সিপিএম। চিনে রাখুন।
হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত বিনয় কোনারের ছবি দিয়ে পোস্ট: আরও সাঁইবাড়ি হোক। pic.twitter.com/84tf82JfDI— Kunal Ghosh (@KunalGhoshAgain) March 17, 2025
কী এই সাঁইবাড়ি কাণ্ড? ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন?
উঠতে বসতে জ্যোতি বসুদের কাছে অপমানিত হতে হতে বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রী (এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিপ্লবীদের তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অন্যতম সদস্য) অজয় মুখোপাধ্যায় নিজের সরকারের বিরুদ্ধেই ধরনায় বসেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গজুড়ে তখন চরম অরাজকতা, নিত্য হানাহানি। জারি হল রাষ্ট্রপতি শাসন। মাত্র ১৩ মাস টেকা যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন হল। ১৭ মার্চ বন্ধ ডাকে সিপিএম। আর ওই তারিখেই বর্ধমান শহরের প্রত্যপেশ্বর শিবতলা লেনের সাঁইবাড়িতে অমল ও স্বর্ণলতা দেবীর এক মাসের শিশুপুত্র অমৃতের নামকরণ উৎসব। সাঁইবাড়ি শিশু অমৃতের মামার বাড়ি। স্বর্ণলতা এই বাড়িরই বড় মেয়ে। আগের দিন, অর্থাৎ ১৬ মার্চ সাঁইবাড়ির মলয়, উদয়, বিজয়, প্রণবরা জিটি রোড আর তেলমারুই রোডের মোড়ে বাজি ফাটিয়েছিল যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনে রাজ্যব্যাপী অরাজকতার অবসান হল, এই আনন্দে। সিপিএমের কট্টর বিরোধী পরিবারের ছেলে ছিল ওরা। ১৭ মার্চও পটকা ফাটাচ্ছিল। তবে রাস্তায় নয়। সাঁইবাড়ির মধ্যে। অমৃতের নামকরণ উৎসবের আনন্দে। বাইরে তখন বন্ধের সমর্থনে ও রাষ্ট্রপতি শাসনের প্রতিবাদে সিপিএমের ‘শান্তিপূর্ণ’ প্রতিবাদ মিছিল বেরিয়েছে। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের হাতে হাতে তির, ধনুক, লাঠি, টাঙ্গি, বর্শা, বোমা।
১৮ মার্চ ‘যুগান্তর’ পত্রিকার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ‘হঠাৎ সিপিআই (এম) মিছিলের উপর একটি পটকা বিস্ফোরণের ফলে একজন সিপিআই (এম) সমর্থক সামান্য আহত হয়। এরপরই ওই মিছিলের একটি অংশ টাঙ্গি, বল্লম ও অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাশের বাড়ি আক্রমণ করে।.. আক্রমণকারীরা ওই বাড়ির ১৩ জন লোককে মারাত্মকভাবে জখম করে। তার মধ্যে মলয় সাঁই, প্রণব সাহি এবং জিতেন রায় ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পরে আক্রমণকারীরা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়।’
২১ মার্চ ‘দৈনিক বসুমতী’ পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায় বাড়িতে আগুন লাগানোর পরবর্তী ঘটনাক্রম। “মৃগনয়না (স্বর্ণলতা দেবীর মা)… মাথায় লাঠির আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ওরা স্বর্ণলতা দেবীর এক মাসের শিশুটাকে (অর্থাৎ, অমৃত যশকে) কেড়ে নিয়ে আগুনের উপর ছুড়ে ফেলে দিতে গিয়েছিল।.. এরপর স্বর্ণলতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।… ওরা বাইরে থেকে প্রথমে প্রণব (সাঁই) কে তিরবিদ্ধ করে..। বড় ছেলে নবকুমারের চোখ ওরা উপড়ে ফেলে।”
তদানীন্তন রাজ্যপাল শান্তিস্বরূপ ধাওয়ান ও তাঁর স্ত্রী ঘটনার পর সাঁইবাড়িতে এসেছিলেন। ১৮, ১৯ ও ২২ মার্চের হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, দ্য স্টেটসম্যান ও অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুগনয়নাদেবী রাজ্যপাল ধাওয়ানকে স্পষ্ট বলেছিলেন, হানাদার হার্মাদরা প্রথমে প্রণব আর মলয়ের রক্ত মৃগনয়না দেবীর গায়ে ছুড়ে দেয়। তারপর ছেলেদের রক্তমাখা ভাত বেড়ে দেয় তাঁর সামনে।
এখানেই শেষ নয়। প্রণব সাঁই, মলয় সাঁই সাঁইবাড়িরই দুই ছেলে। অপর জন জিতেন রায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। তিনি ছিলেন ওই বাড়ির গৃহশিক্ষক। তাঁরা তো ১৭ মার্চের ঘটনায় নিহত। বড় ছেলে নবকুমার সেদিন চোখ হারালেও প্রাণে বেঁচেছিলেন। সিপিএমের হার্মাদরা তাঁকে ১৯৭২-এর ১২ জুন খুন করে বলে অভিযোগ। সেদিন ছিল নবকুমারের জন্মদিন। মা মৃগনয়না ছেলের জন্মদিনে পায়েস রেধে অপেক্ষা করছিলেন। আর বর্ধমানের কংগ্রেস অফিসে মিথ্যে খবর পাঠিয়ে নবকুমারকে দামোদর নদের পাড়ে আহ্লাদপুরে ডেকে পাঠিয়ে খুন করা হয়।
পুলিশ মোকদ্দমা নং ৫০/১৭.০৩.১৯৭০-এ মোট ছ’টি ধারায় ১৩ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু করা হয়। অভিযুক্তদের তালিকায় ১১ নং নাম বিনয় কোঙার, ৬৩ নং নাম নিরুপম সেন, ৩৬ নং নাম রামনারায়ণ গোস্বামী। চার্জশিটেও নাম ছিল ওদের। টিআই প্যারেডে খোকন ওরফে নিরুপম সেন এবং বিনয় কোঙারকে শনাক্ত করলেন স্বর্ণলতা দেবী। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। সাঁইবাড়ি বিচার পায়নি বলে দাবি।
১৯৭৭। রাজ্যে এল বামফ্রন্ট। ২০ সেপ্টেম্বর সরকারি কৌঁসুলি সাঁইবাড়ি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করলেন। বিচারক গীতেশরঞ্জন ভট্টাচার্য সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে চারজন আসামির বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেও বাকি ৭৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা চালু হল। ফলস্বরূপ গীতেশরঞ্জনকে সরিয়ে দেওয়া হল ওই আদালত থেকে। তাঁর জায়গায় এলেন রবীন্দ্রকমল কর। তিনি ৬ মে, ১৯৭৮-এ তাঁর রায়ে জানালেন, মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন খারিজ করার বিরুদ্ধে তিনি কোনও কারণ দেখতে পাচ্ছেন না। ব্যস। সব শেষ। সাঁইবাড়ি বিচার পাবে কোথেকে!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.