পলাশ পাত্র, তেহট্ট: বয়সের ভার অনেক। তবে তা সত্ত্বেও ছেদ পড়েনি ঐতিহ্যে। আজও সেই একইভাবে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে পূজিতা হন মা জগদ্ধাত্রী। দুর্গাপুজোর পর আরও একবার উৎসবের আনন্দকে চেটেপুটে উপভোগ করার জন্য কৃষ্ণনগরের সবচেয়ে প্রাচীন এই পুজোয় ভিড় জমিয়েছেন বহু মানুষ। তাই তো নবমীর সন্ধেয় তিলধারণের জায়গা নেই রাজবাড়িতে। খাওয়াদাওয়া-হই হুল্লোড়ে বছরের এই একটা দিন যেন প্রাণ ফিরে পায় একসময়ের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্ব।
তবে এই রাজবাড়িতে ঠিক কীভাবে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হল, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ১৭৫৪ সালে বিশাল অঙ্কের কর জমা দিতে না পারায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে কারাগারে বন্দি করেছিলেন নবাব আলিবর্দি খান। দশমীর দিন তিনি নবাবের কারাগার থেকে মুক্তি পান। নদীর উপর নৌকায় চেপে কৃষ্ণনগর ফেরার পথে মনমরা হয়েছিলেন মহারাজ। একসময় তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। স্বপ্নে মহারাজা দেখেছিলেন এক রক্তবর্ণা চতুর্ভুজা কুমারী দেবীকে। মহারাজাকে কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে পুজোর নির্দেশ দেন তিনি।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বংশধর তথা রাজবাড়ির বর্তমান গৃহকর্তা সৌমীশচন্দ্র রায় বলেন, “১৭৬৪ সালে মীরকাশিম মুঙ্গেরের কারাগারে বন্দি করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর পুত্র শিবচন্দ্রকে। কারণ তাঁর কানে এসেছিল কৃষ্ণচন্দ্র ইংরেজদের ঘনিষ্ঠ। তাই মীরকাশিম কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। এই সময় কারাগারে দেবীর স্বপ্ন দেখেন কৃষ্ণচন্দ্র। এই স্বপ্নের কথা তিনি তাঁর লোক মারফৎ তান্ত্রিক কালীশংকর মৈত্রের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কালীশংকর তাঁর প্রাণরক্ষার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র কালীশংকর মৈত্রকে এই স্বপ্নের বিষয়ে জিজ্ঞাসাও করেন। কালীশংকর জানিয়েছিলেন দেবী স্বয়ং চণ্ডী। স্বপ্নাদেশে কৃষ্ণচন্দ্র দেবীর দর্শন পেয়েছিলেন। মহারাজা আর দেরী করেননি। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবীর পুজো করা হবে বলেই জানিয়ে দেন কৃষ্ণচন্দ্র। তবে একটাই চিন্তা ছিল রাজপরিবারের কুলগুরু নতুন দেবীর পুজোর অনুমতি দেবেন তো? মহারাজা তাই চন্দননগরে তাঁর বন্ধু ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরির সঙ্গে কথা বলতে যান। তবে পুজোর দায়িত্ব ছেলে শিবচন্দ্র এবং গোপাল ভাঁড়কে দিয়ে যান। পুজোর আগের দিন গভীর রাতে গোপনে কৃষ্ণনগরের প্রাসাদে ফিরে আসেন মহারাজা। অঞ্জলিও দিয়েছিলেন। সেই থেকেই শুরু হল রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো।”
একসময় কৃষ্ণচন্দ্রের হাতে করে পুজো করা পাথরের জগদ্ধাত্রী, দুর্গা, পাঁচ মাথা শিব ও শিবলিঙ্গ ছিল। তবে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীন হলেও কৃষ্ণনগর পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায়। র্যাডক্লিফের ভুল মানচিত্রের জন্য এই সমস্যা হয়। এই বিগ্রহও চলে যায় পাকিস্তানে। এই সময় রানি জ্যোতির্ময়ী দেবী পদক্ষেপ নেন। কৃষ্ণনগরকে ফের এ দেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ভাঙা মূর্তিটিও ফেরত পায় নদিয়ার রাজপরিবার। এবারও জগদ্ধাত্রী পুজোয় নাট মন্দিরে সেই মূর্তিই পুজোই হয়। এখনও আগের মতো নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিনবার পুজো হয়। খিচুড়ি, পোলাও, তিন কিংবা পাঁচ রকমের মাছ, তরকারি, মিষ্টি, পায়েস দিয়ে মূলত ভোগ দেওয়া হয়। রাজপরিবারের জগদ্ধাত্রী পুজো এখন প্রকৃত অর্থে সর্বজনীনের রূপ নিয়েছে। গ্রামের বহু মানুষই ভিড় জমান এখানে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.