বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: ২০১৯-এর পুনরাবৃত্তি! নেপথ্যে দাঁড়িয়ে কেএলও সুপ্রিমো জীবন সিংহের কৌশলী চালে এবারও লোকসভা নির্বাচনে লোপাট কামতাপুরি ভোট! ধরাশায়ী কামতাপুর পিপলস পার্টি (কেপিপি)!
ভোটের ফলাফল পর্যালোচনার পর প্রাথমিকভাবে অন্তত এমনটাই মনে করছেন কেপিপি নেতৃত্ব। তাদের মতে কামতাপুরি ভোট হাইজ্যাক করে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও উত্তর মালদহ আসনে গেরুয়া শিবিরের জয়ের পথ মসৃণ করেছেন জীবন সিংহ। ব্যতিক্রম ছিল কোচবিহার। সেখানে এমনিতেই কেপিপি এবং গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের দ্বন্দ্বের জেরে রাজবংশী তথা কামতাপুরী ভোট ব্যাঙ্কে বিভাজন স্পষ্ট ছিল। কেএলও সুপ্রিমোর হুইপ কাজে লাগেনি। কামতাপুরি ভোট পদ্ম শিবির থেকে ঘাসফুলে চলে যাওয়ায় ওই আসন তৃণমূল দখল করেছে। কেপিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নিখিল রায় বলেন, “এবারও আমরা প্রযুক্তি, অপপ্রচারের কাছে হেরে গেলাম। আমাদের নিজস্ব ভোট ঘরে ফেরাতে পারলাম না। বেশিটা বিজেপিতে চলে গেল।”
যদিও উত্তরের ভূমিপুত্রদের ভোট তুলে নিতে জীবন সিংহের ভিডিও ক্লিপিংস বাজারে ছেড়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে গেরুয়া শিবির এমন শঙ্কা কেপিপির অন্দরে ছিলই। যে কারণে ভোটের নির্ঘন্ট ঘোষণার পরই কর্মীদের সতর্ক করার কাজ শুরু করেছিল দল। কিন্তু লাভ যে হয়নি ভোটের ফলাফলে স্পষ্ট। কোনও আসনে নোটায় প্রদত্ত ভোটের সীমানা অতিক্রম করতে পারেনি কেপিপি। অথচ তাদের মিছিল, মিটিংয়ে ভিড় দেখা গিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে সেই ভোট গেল কোথায়?
কেপিপি নেতৃত্বের অভিযোগ, কামতাপুরি অথবা গ্রেটার কোচবিহারের নামে চলা কিছু নেতা বিক্রি হয়েছেন। তারা যেখানে কেপিপির সংগঠন রয়েছে সেখানে পড়ে থেকে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন। তার উপরে ছিল গরম ভাষণে ঠাসা জীবন সিংহের ভিডিও ক্লিপিংস। সেসব হাতে হাতে ঘুরেছে। পরিণতিতে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। যদিও কেপিপি নেতৃত্বের একাংশ পালটা প্রশ্ন তুলেছেন, কিছু নেতা বিক্রি হলেও দলের তরফে কি সেভাবে জীবন সিংহের প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে প্রচার ছিল? কারণ, জীবন সিংহের ভিডিও বার্তা ইস্যুতে দলের অন্দরেই ছিল দ্বন্দ্ব। ঘরোয়া বৈঠকে কর্মী সমর্থকদের সতর্ক করা হলেও ভোট প্রচারে জীবন সম্পর্কে কোনও বক্তব্য প্রকাশ্যে আনতে রাজি হননি দলীয় নেতৃত্বের বড় অংশ।
জীবন সিংহের ভিডিও বার্তায় ছিল রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ। পরোক্ষে বিজেপির প্রশংসা। কেপিপি নেতৃত্বের বড় অংশ চায়নি ওই বিষয়ে দলের তরফে প্রকাশ্যে কিছু বলা হোক। কেপিপি-র সাধারণ সম্পাদক সুভাষ বর্মন অভিযোগ করেন, কামতাপুরি ভোট যেমন কেপিপি প্রার্থী পায়নি, একইভাবে কংগ্রেস-বাম জোটেও যায়নি। অর্থাৎ জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও উত্তর মালদহ আসনে জীবন সিংহের নির্দেশ মতো গেরুয়া শিবিরে স্যুইং করেছে। বংশীবদনদের চেষ্টায় সামান্য ভোট তৃণমূল পেয়েছে। সুভাষবাবু বলেন, “২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে উত্তরের কামতাপুরি ভোটের পুরোটা চলে গিয়েছিল পদ্ম শিবিরে। আমরা ঠেকাতে পারিনি। এবার দুই ফুল শিবির কামতাপুরি ভোট দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। কিন্তু কোচবিহার ছাড়া কোথাও সুবিধা করতে পারেনি তৃণমূল।”
এদিকে ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর থেকে ‘ইউনাইটেড ফোরাম ফর সেপারেট স্টেট’ মঞ্চের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পৃথক রাজ্যের দাবিতে যৌথ আন্দোলন এবং উত্তরের পাহাড়-সমতলে ভোট ভাগ ঠেকাতে মূলত কেপিপির উদ্যোগে তৈরি হয় মঞ্চ। সেখানে সদস্য রয়েছে কামতাপুর প্রোগ্রেসিভ পার্টি, গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন, বীর বিরসা মুন্ডা ইল উলগান, ভূমিপুত্র কো-অর্ডিনেশন পার্টি এবং বিমল গুরুংয়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। কিন্তু ভোটের আসরে গুরুং মঞ্চের নীতি ভেঙে বিজেপি প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার দায়িত্ব নেন। পাশাপাশি অন্য সংগঠনের কয়েকটি চলে যায় তৃণমূল শিবিরে। মঞ্চের মুখপাত্র নিখিল রায় বলেন, “বিরাট রাজনৈতিক ভুল হয়ে গেল। এই পরিস্থিতি হবে সেটা ভাবতে পারিনি।” প্রশ্ন উঠেছে এর পর ওই মঞ্চকে কেউ বিশ্বাস করবে!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.