Advertisement
Advertisement

চলে গেলেন পতাকা গবেষক কালী স্যর, শোকস্তব্ধ আসানসোল

দেশের প্রথম ও একমাত্র পতাকা গবেষক আসানসোলের কালীশংকর ভট্টাচার্য।

Kalishankar Bhattacharya passed away
Published by: Sayani Sen
  • Posted:January 23, 2019 6:32 pm
  • Updated:January 23, 2019 6:32 pm  

চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়, আসানসোল: প্রয়াত দেশের প্রথম ও একমাত্র পতাকা গবেষক আসানসোলের কালীশংকর ভট্টাচার্য। ৮৩ বছর বয়সে গত রবিবার মারা যান তিনি। বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আসানসোলের গোপালপুরের বাসিন্দা প্রাক্তন রেলকর্মী তথা শিক্ষক কালীশংকর ভট্টাচার্য৷ দোমাহানি মহাশশ্মানে শেষকৃত্য সমপন্ন হয় তাঁর। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি পতাকার মতো বিষয় নিয়ে প্রথম গবেষণা করে ডক্টরেট হয়েছেন। দেশ বিদেশের জাতীয় পতাকা, ধর্মীয় পতাকা, রাজনৈতিক পতাকা মিলিয়ে ৪২২টি পতাকার ইতিহাস ও সন্ধান রয়েছে তাঁর গবেষণাধর্মী রিপোর্টে।

দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আর জাতীয় মর্যাদার প্রতীক হল জাতীয় পতাকা। ভারতের ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকার ইতিহাস নিয়ে পাঠ্য বইয়ে যা নেই, তা সংরক্ষিত ছিল আসানসোলের কালীশংকরবাবুর কাছে। সারা বিশ্বের পতাকা নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। দেশ বিদেশের জাতীয় পতাকা, ধর্মীয় পতাকা, রাজনৈতিক পতাকা মিলিয়ে ৪২২টি পতাকার ইতিহাস ও সন্ধান রয়েছে তাঁর গবেষণাধর্মী রিপোর্টে। যা দেখে চমকে গিয়েছেন দেশের ঐতিহাসিকরাও। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি পতাকার মতো বিষয় নিয়ে প্রথম গবেষণা করে ডক্টরেট হয়েছেন। ভারতের জাতীয় পতাকার প্রস্তাবিত ও গৃহীতরূপ নিয়ে আলোকপাত করেছেন তিনি। ভারতবর্ষের প্রস্তাবিত ও উত্তোলিত জাতীয় পতাকার বিবর্তন হয়েছে ১৭ বার। গবেষণার সেই মডেল পতাকাগুলি সংরক্ষিত ছিল কালীশংকরবাবুর কাছে।

Advertisement

নতুন রূপে সেজে উঠল নেতাজির কোদালিয়ার বাড়ি, ভিড় বাড়ছে দর্শনার্থীদের

ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকার প্রবর্তন হয়েছিল ১৮৮৩ সালে। ‘জাতীয়’ কথাটির উদ্ভবও হয় সেই প্রথম। সাদা বর্গাকার পতাকার মাঝে ছিল রক্তিম সূর্য। লাহোর নিবাসী শিরিষচন্দ্র বসু কতৃক এই পতাকাটি প্রস্তাবিত হয়। ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলিত করেছিলেন অনুশীলন সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কলকাতার পার্সি বাগান স্কোয়্যারে সেই পতাকাটি উত্তোলিত হয়েছিল। ওই একই দিনে কলকাতার স্বদেশি আন্দোলনকারীরা ধর্মতলা পার্কে গভর্নর হাউসের সামনে গোপনে পতাকাটি উত্তোলন করেন। পতাকার রং ছিল ত্রিবর্ণ। উপরে লাল, মাঝে হলুদ নিচে সবুজ। লালের উপর আঁকা অষ্টবৃন্তের আটটি কুসুম। হলুদের উপর সংস্কৃতে লেখা বন্দেমাতরম। সবুজের উপর সূর্য ও অর্ধচন্দ্র। ওই একই আদলে চার রকমের পতাকার বিবর্তন হয়। মেদিনীপুরের স্বদেশি আন্দোলনকারীরা যে পতাকাটি প্রস্তাবিত করেছিলেন তা ছিল লাল, হলুদ ও নীল। আর বাংলায় লেখা বন্দেমাতরম। ব্রিটিশ শাসনে আটটি প্রদেশকে চিহ্নিত করতে কখনও প্রস্ফুটিত পদ্ম, কখনও অষ্ট কুসুমকে পতাকার উপরে স্থান দেওয়া হয়েছিল।

Flag researcher

এক মিনিটেই আঁকেন নেতাজির নিখুঁত ছবি, বাংলার বিস্ময় বিশ্বনাথ

১৯০৬ সালে বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর সমিতি পার্টি কংগ্রেসে যে পতাকাটি প্রস্তাব করেছিল সেটি ছিল লাল রঙের। ঋষি অরবিন্দের ভাই বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ ও স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবিত পতাকাটি দেখতে ছিল তলোয়ার ও ত্রিশূলের গুণিতক আকার। উপরে চাঁদ ও নিচে চক্র। দেশের বাইরে প্রথম প্রস্তাবিত ও গৃহীত জাতীয় পতাকাটি উত্তোলন করেছিলেন এক ফরাসি নাগরিক মাদাম কামা। ১৯০৭ সালের ২২ আগস্ট জার্মানির স্টুটগার্টে আর্ন্তজাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে ওই পতাকাটি উত্তোলিত হয়। কালীবাবুর গবেষণা রিপোর্ট বলছে, ওই পতাকার নাম ‘সপ্তর্ষি পতাকা’। উপরে লাল, মাঝে হলুদ ও নিচে সবুজ। গৈরিকের উপর আঁকা একটি কুসুমের সঙ্গে সাতটি তারা। মাঝে বন্দেমাতরম লেখা ও নিচে সবুজের উপর সূর্য-চন্দ্র।

Flag researcher
১৯০৯ সালে ভগিনী নিবেদিতা প্রস্তাবিত জাতীয় পতাকাটি ছিল লাল রঙের। পতাকার মধ্যে বজ্রকুসুম দণ্ড। তার মধ্যে লেখা বন্দেমাতরম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সেই পতাকাটির ছবি ছাপা হয়। যেহেতু দধিচির হাড় দিয়ে বজ্র তৈরি হয়েছিল তাই তিনি বজ্রকে ত্যাগের প্রতীক বলে মনে করতেন। আর ভারতবর্ষের মানুষের মন কসুমের মতো। ১৯১৬ সালে লোকমান্য তিলক ও অ্যানি বেসান্ত হোমরুল লিগে যে জাতীয় পতাকাটি উত্তোলন করেছিলেন সেটি লাল সবুজ স্ট্রাইপের। উপরের বাম কোণে ইউনিয়ন জ্যাকের সিম্বল। পতাকার মাঝে সপ্তর্ষি ও চাঁদ। এটি পঞ্চকোনি অর্থাৎ পাঁচ কোণের পতাকা। বেশ কয়েকবছর এটি উত্তোলিত হয়েছিল। 

১৯২২ সালে বিজয়ওয়াড়ায় কংগ্রেস কমিটির মিটিংয়ে মহাত্মা গান্ধীর উপস্থিতিতে জাতীয় পতাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেখানে ঠিক হয় জাতীয় পতাকায় কোন জাতীয় চরিত্রকে চিহ্নিত করা হবে। পিঙ্গোলি বেঙ্কাইয়া নামক এক ছাত্র একটি পতাকা তৈরি করে নিয়ে আসেন, যার উপরে লাল নিচে সবুজ ও মাঝে চরকা। ১৯২৩ সালে কংগ্রেস কমিটির  বৈঠকে ওই লাল-সবুজ পতাকাটি উলটে দেওয়া হয়। পরিবর্তে নিচে লাল, উপরে সবুজ ও তার উপর সাদা ও মাঝে চরকা আঁকা হয়। এই প্রথম সর্বধর্ম সমন্বয়কে মাথায় রেখে জাতীয় পতাকা তৈরি হয়। তৈরি করেন গান্ধীজি। লাল এখানে বৃহত্তর হিন্দু ধর্ম, যারা সমস্ত ধর্মকে বহন করবে, তাই নিচে। উপরে সবুজ মানে মুসলিম সম্প্রদায়। তার উপরে সাদা মানে সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। ১৯২৩-১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই পতাকাটি উত্তোলিত হয়।

১৯৩১ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় পতাকার রং পরিবর্তিত হয়৷ উপরে গৈরিক, মাঝে সাদা, নিচে সবুজ৷ সঙ্গে ছিল চরকা। ১৯৪৭ সালের ২২ আগস্ট চরকার পরিবর্তে সারনাথে যে অশোক চক্রটি রয়েছে, সেই ২৪ স্পোকের চক্রটি নীল রঙে আঁকা হয়। অশোক চক্রটি নেওয়ার অর্থ অশোক বিশ্বজয় করেও অহিংসার পথ বেছে নিয়েছিলেন৷ জওহরলাল নেহেরুর পছন্দ হয়েছিল এই ভাবনাটি।

নেতাজির চিঠি ও চেয়ার আজও সযত্নে রক্ষিত আসানসোলের রায় পরিবারে

পতাকা নিয়ে যার এই গবেষনা সেই কালীশংকরবাবুর জন্ম বাংলাদেশে হলেও, কলকাতা চলে আসেন ১৯৪৮ সালে। অর্থাভাবের মাঝেই পড়াশোনা করেন তিনি। হোটেলে কাপ-প্লেটও ধুয়েছেন। বঙ্গবাসী কলেজে বিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে চাকরি পান আসানসোলের রেলে। কালীবাবুর জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসার বুঝতে পেরে রেলের স্কুল পরিদর্শন কমিটিতে নিয়ে আসা হয় তাঁকে। ছোটবেলায় বাবার একটি ডায়েরিতে কয়েকটি দেশের পতাকা দেখে উৎসাহ জাগে। পড়াশোনা চলাকালীন বিভিন্ন পতাকা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এমনকি চাকরি জীবনেও পতাকার গবেষণা চালিয়ে যান। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ২০০৮ সালে প্রথম গবেষণার রিপোর্টটি জমা দেন। ২০১০-এ তৎকালীন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন তাঁকে পুরস্কৃত করেন ও পিএইচডি প্রদান করেন। এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। ৮৪ বছর বয়সেও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন কালী স্যার। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল অশোক চক্র। দেশ-বিদেশে সমাদৃত হয়েছেন কালীশংকরবাবু। গত রবিবার বার্ধক্যজনিত রোগে মারা গিয়েছেন তিনি৷ কিন্তু আক্ষেপ একটাই রাজ্য সরকারি মঞ্চে কোনও স্বীকৃতি পাননি কালীশংকরবাবু৷

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement