সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: লাঠি খেলার আখড়াতেই শ্যামা মায়ের আরাধনা। ব্রিটিশ (British) তাড়াতে শক্তির দেবী মা কালীর আরাধনা শুরু করেছিলেন লাঠিয়াল, স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা পুরুলিয়ার (Purulia) ‘প্রথম শহিদ’ সত্যকিঙ্কর দত্ত সহ অন্যান্য বিপ্লবীরা। জঙ্গলের মধ্যে বেদী গড়ে মা কালীর ছবি দিয়ে শুরু হওয়া পুজো আজও চলছে কার্তিকের অমাবস্যায়। স্বাধীনতার সংগ্রামীদের এই পুজো এবার ৯৫ বছরে পড়ল। কার্তিকের অমাবস্যা ছাড়াও মাঘ মাসের প্রথম তিনদিন স্বাধীনতার সংগ্রামী সত্যকিঙ্কর দত্তের স্মৃতিতে যখন সত্য মেলা হয়, সেই সময়ও দেবী পুজো পান। তখন অবশ্য মায়ের মূর্তি গড়া হয়। অর্থাৎ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শুরু করা আরাধনায় বছরে দুবার পুজো পান শ্যামাদেবী। কালীপুজোকে (Kali Puja) ঘিরে এমন ইতিহাস সেভাবে দেখা মেলে না।
পুরুলিয়ার ঝালদা (Jhalda)শহর থেকে ২ কিলোমিটার দূরে ঝালদা ১ নম্বর ব্লকের গোকুলনগর, চাতমঘুটু, নতুনডি গ্রামের মধ্যস্থলে পলাশ জঙ্গলে মা কালীর বেদি। সেখানেই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী সত্যকিঙ্কর দত্তের লাঠি খেলার আখড়া। এলাকার মানুষজনদের সঙ্গে কথা বলে বা মানভূমের ইতিহাসের (History)পাতা উলটে যা জানা যায়, তাতে ১৯২৮ সালে ওই কালীপুজোর সূচনা করেছিলেন সত্যকিঙ্কর দত্ত-সহ অন্যান্য সংগ্রামীরা। ফি বছরের মত এবারও সেই পুজোর প্রস্তুতি শুরু করেছেন এলাকার মানুষজন। তবে শুধু ওই তিনটি গ্রাম নয়। কয়ালডি, ওনা, কাড়বাঁধি গ্রামের মানুষজনও এই কালীপুজোয় শামিল হন।
চাতমঘুটু গ্রামের বাসিন্দা সুশান্ত মাহাতো, গোকুলনগরের ত্রিলোচন কর্মকার বলেন, “আমরা যতটুকু জানি, লাঠি খেলার মাস্টার তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী শহীদ সত্যকিঙ্কর দত্ত-সহ অন্যান্য সংগ্রামীরা মিলে ১৯২৮ সালে এই কালীপুজোর সূচনা করেছিলেন। সেই সময় থেকে এই পুজো হয়ে আসছে। কার্তিক মাসের অমাবস্যার পাশাপাশি মাঘ মাসেও মা এখানে পুজো পান। আমরাই চাঁদা আদায় করে এই পুজো করে থাকি।” এমনি সময় এই জঙ্গল পা রাখলে গা ছমছম করলেও, মায়ের আরাধনায় সেই ভয়টা যেন উধাও হয়ে যায়।
১৯২৮ সালে এই পুজোর সূচনা হলেও ১৯২৯ সালে ১০ ডিসেম্বর গুপ্ত ঘাতকের বিষমাখানো ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সত্যকিঙ্কর জখম হন। তারপর ১৩ ডিসেম্বর পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে তিনি মারা যান। এই মৃত্যুর ঘটনায় শুধু ঝালদা নয়, নাড়িয়ে দিয়ে যায় সমগ্র সাবেক মানভূমকেই। এই ঘটনায় ব্রিটিশদের পক্ষ নেওয়া রাজ পরিবারের নাম জড়ায়। হত্যাকাণ্ডে (Murder Case) জড়িত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ পুলিশ কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় এলাকার মানুষজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
ওই সংগ্রামীর মৃত্যুর এক মাস দু’দিন পরেই তাঁর স্মৃতিতে ১৯৩০ সালের ১৫ জানুয়ারি (১ মাঘ) সত্য মেলার আয়োজন করে ঝালদা যুব সংঘ। মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে টুসু মেলাকে সামনে রেখেই এই মেলা বসে। আরেকটু ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে জানা যায়, ১৯২২ সালে ২৭-২৮ এপ্রিল ঝালদায় মানভূমের দ্বিতীয় রাজনৈতিক সম্মেলন হয়। সেই সম্মেলনে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, প্রফুল্ল চন্দ্র-ঘোষ সহ আরও নানান বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্মেলনে ছিলেন। যুব কর্মী সত্যকিঙ্কর দত্ত ওই সম্মেলনের স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। এই সম্মেলনের পরেই ঝালদায় স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও তার আগে থেকেই এলাকায় লাঠি খেলা শেখাতেন সত্যকিঙ্কর। ওই সম্মেলনের পরেই তিনি আরও ভালোভাবে ব্রিটিশদের নজরে চলে আসেন। নজরে আসেন ব্রিটিশদের পক্ষে থাকা তৎকালীন রাজ পরিবারের চোখেও। ওই সময়ই কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠলে ক্ষেপে যান সরকারের পক্ষে থাকা রাজা। ১৯৩১ সালের সত্য মেলায় ব্রিটিশ পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু তা উপেক্ষা করেই ওই মেলায় অংশ নেন এলাকার মানুষজন। মেলাকে ঘিরে ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডা শুরু হয় নতুনডি গ্রামের গোলক মাহাতোর। এরপরই গুলি চালায় ব্রিটিশ পুলিশ। শহিদ হন পাঁচজন। এই হত্যাকাণ্ড শুধু তৎকালীন মানভূমে নয় বিহার এবং ওড়িশার রাজনীতিতে আলোচিত হয়।
তারপর থেকে ওই মেলা বন্ধ হয়ে গেলেও ১৯৭৪ সালে পুরুলিয়ার তৎকালীন সাংসদ দেবেন্দ্রনাথ মাহাতো আবার মাঘ মাসের একই সময়ে মেলা শুরু করেন। সেই মেলা এখনও চলছে। চলছে মায়ের আরাধনাও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.