বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: বাংলার ‘হ্যালোউইন’ ভূত চতুর্দশীর পরদিন, রবিবার অন্য আলোর উৎসবে মাতলো উত্তরের গ্রাম। ‘গছা দেওয়া’ অনুষ্ঠানে আঁধার রাতে ঘরদোর, শস্যখেত অলোকমালায় সেজে উঠল। এদিন গায়ের ছেলেরা মেতেছে ‘চোর খেলায়’। বাড়ির কচিকাঁচারা কোথাও লন্ঠনের আদলে পাটকাঠির তৈরি খাঁচায় প্রদীপ রেখে ‘ন্যালটেং’ নামে আলো নিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার কোথাও নারকেলের মালায় হাতল লাগিয়ে মোম জ্বেলে টর্চ বানিয়েছে। কোথাও বসেছে ‘চোর চুরনী’ পালাগানের আসর। মালদহ (Maldah) ও দুই দিনাজপুর জেলায় পূর্ব পুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানাতে আয়োজন হয়েছে ‘হকাহকি’ অনুষ্ঠান।
কালীপুজোর (Kali Puja 2023) রাতে চাষি পরিবারের গ্রাম দেবতার থানের সামনে চারটি এবং ঘরের সামনে দুটি কলাগাছ পুঁতে গোড়ার মাটি গোবর দিয়ে লেপে দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় ‘অধিকারী’ নামে পরিচিত পূজারী পুজোর আয়োজন করেন। এরপর বাড়ির লোকজন স্নান সেরে মাটির প্রদীপে আলো জ্বেলে দেন। সূচনা হয় ‘গছা দেওয়া’ অনুষ্ঠানের। বৃত্ত শেষ হয় ধানের খেতে কলাপাতার ডাটা কেটে তৈরি প্রদীপে সলতে জ্বালিয়ে। গছা দেওয়া পর্ব শেষ হলে ছেলেরা দলবেঁধে চোর খেলায় মেতে ওঠে। এই চোর খেলা ‘কালা চোরা’ নামেও পরিচিত। তবে শুধুমাত্র রাজবংশী সমাজ নয়। উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে ওই প্রথা প্রচলিত রয়েছে। বিশেষত হাজং, কোচ, রাভা সমাজে চোর খেলা দেখা যায়। কালা চোরা উৎসবের অর্থ ‘কালের গর্ভে বিলীন হওয়া’। এই খেলায় পড়শির বাড়ি থেকে কোনও একটি জিনিস চুরি করতে হয়। তবে কেউ যেন টের না পায়।
কাজটি মোটেও সহজ নয়। কারণ, ওই রাতে অনেকেই রাত জেগে বাড়ি পাহারা দেয়। তাই কৌশলে কাজ হাসিলের চেষ্টা চলে। এদিকে রাতভর চলে চোর চুরনী পালা গানের আসর। তিস্তা-তোর্সাপাড়ে আলোর উৎসব শেষ না হতে মালদহ, উত্তর দিনাজপুর (Uttar Dinajpur) ও দক্ষিণ দিনাজপুরে (Dakshin Dinajpur) শুরু হবে হকাহকি অনুষ্ঠান। অভিনব ওই আলোর উৎসবে পাটকাঠিতে আগুন জ্বেলে ছুড়ে ফেলা হয়। আবার কোথাও জ্বলন্ত পাটকাঠি নিয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ করতে দেখা যায়। প্রচলিত বিশ্বাস আঁধার রাতে আলোর সন্ধান পেয়ে পূর্ব পূরুষরা প্রসন্ন হয়ে আশীর্বাদ করেন। গ্রামে শান্তি ফেরে।
ঠিক কবে নাগাদ গছা দেওয়া অনুষ্ঠানের সূত্রপাত সেটা অবশ্য এখন জানার উপায় নেই। লোকসংস্কৃতি গবেষকদের একাংশের দাবি, কৃষি সভ্যতা বিকাশের হাত ধরে বিভিন্ন প্রথার মতোই গছা দেওয়া অনুষ্ঠানের সূচনা হয়ে থাকতে পারে। লোকসংস্কৃতির গবেষক ‘বঙ্গশ্রী’ দীনেশচন্দ্র রায় মনে করেন, গছা দেওয়া উৎসব আদতে কৃষি বন্দনা। কার্তিক মাসে ধানের খেতে পোকার উপদ্রব বেড়ে যায়। পোকা তাড়াতে আগুনের ব্যবহার অনেকদিনের। গছা দেওয়া সেটারই প্রতীক। অবশ্য গ্রামের বাসিন্দাদের অনেকের দাবি, শুধু কৃষি বন্দনা নয়। গছা দেওয়া, ছেলেদের ন্যালটেং নিয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণের মধ্যে অশুভ শক্তি জয়ের আর্তিও থাকে। তবে ওই ভাবনার সঙ্গে একমত নন লোকসংস্কৃতি গবেষক দিলীপ বর্মা। তিনি জানান, গছা দেওয়ার মতো অনুষ্ঠান পুরোপুরি কৃষি ভিত্তিক। অনেক পরে অশুভ শক্তি জয়ের ভাবনা জুড়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.