সুনীপা চক্রবর্তী, ঝাড়গ্রাম: স্বাধীনতার ৭২তম বছর পালন করল ডিজিটাল ইন্ডিয়া। কিন্তু আজও ভারতবর্ষের একাংশ কুসংস্কারের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। সাপের কামড়ে মৃত শিশুকন্যাকে নিয়ে প্রায় দেড় দিন ধরে চলল পুজোপাঠ, ঝাড়ফুঁক। ওঝা ডেকেও তুকতাক করানো হল। শেষে কলার ভেলায় মৃত শিশুকে রেখে ঘাতক সাপকে ভেলার সঙ্গে বেঁধে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হল। যাতে লখিন্দরের মতো সেও বেঁচে ফিরতে পারে। কিন্তু চেষ্টা সফল হল না। যথা সময়ে পুলিশ উপস্থিত হয়ে শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করল।
ঘটনাটি ঘটেছে ঝাড়গ্রাম জেলার বিনপুর থানার কুঁই গ্রামে। পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৪ আগস্ট রাতে কুঁই গ্রামের বাসিন্দা পেশায় দিনমজুর বাপি খাঁ তার চার বছরের মেয়ে অনুকে নিয়ে খাটে ঘুমাচ্ছিল। গভীর রাতে শিশুটি যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে। বাবাকে ডেকে বলে তাকে সাপে কামড়ে দিয়েছে। কিন্তু বাবা কিছু হয়নি বলে তাকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয়। পরদিন সকালে অনুর শরীর খারাপ হতে শুরু করে। বমি করতে শুরু করে সে। খুঁজে দেখা যায় বিছানায় একটি চিতি সাপ রয়েছে। সবাই মিলে সাপটিকে মেরে ফলে। শিশুটির শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে প্রথমে বিনপুরে গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে পরে ঝাড়গ্রাম জেলা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, সেখান থেকে আবার মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয় অনুকে। কিন্তু মেদিনীপুর নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
[স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্কুলে যাওয়ার পথে রেললাইনে পড়ে মৃত্যু শিক্ষিকার]
এরপর শুরু হয় কুসংস্কারের তাণ্ডব। জানা গিয়েছে, শিশুটির পরিবার এরপর আর গ্রামে ফিরে আসেনি। তারা মনে করে নদীতে ভাসিয়ে দিলে সন্তান বেঁচে উঠবে। খাঁ পরিবার মৃত অনুকে নিয়ে সোজা চলে যায় লালগড় থানার লাঘাটা গ্রামে। সেখানে বিকেল নাগাদ একটি ভেলাতে অনুর দেহ তোলা হয়। সেই ভেলাতে বেঁধে দেওয়া হয় মরা সাপটিকেও। ফুল, মালা দিয়ে কংসাবতী নদীর জলে ভসিয়ে দেওয়া হয়। ভাসিয়ে দেওয়ার কিছু পরেই তারা খবর পায় গ্রামের এক গুনিন আছে যে কিনা সাপে কাটা মৃতকেও বাঁচিয়ে তুলতে পারে। এরপর নদী থেকে মৃত দেহটি তুলে আনা হয়। লাঘাটা গ্রামের ওই গুনিনের বাড়িতে রাতভর চলে মনসা পুজো। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত পুজা চললেও দেহে সাড় না দেখে আবারও দেহটিকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যেই দেহটি ফুলে, ফেঁপে গিয়েছিল। খবর ছড়িয়ে পড়তেই আশেপাশের গ্রামের লোকজন এসে জড়ো হয়। বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত চলে দেহ ভাসানোর তোড়জোড়। শেষ পর্যন্ত লালগড় থানার পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে মৃতদেহটি উদ্ধার করে।
অন্যদিকে বিনপুর থানার পুলিশ এদিন সকালেই খবর পেয়ে কুঁই গ্রামে পৌছে খাঁ পরিবারের কাউকেই গ্রামে পায়নি। অত্যন্ত গোপনে মৃতদেহ রেখে পুজো থেকে শুরু করে ভাসানোর এই প্রক্রিয়া চলছিল। লাঘাটা গ্রামেও যখন এই কাজ হচ্ছিল, তখনও গ্রামের কেউ মুখ খুলতে চাইছিলেন না। লাঘাটা গ্রামের নদীর কাছে দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে মথুর দাস, গৌতম দাসরা বলেন, “আমরা কিছু জানি না। দেখছি একটা সাপে কাটা বাচ্চাকে নদীতে ভাসানো হচ্ছে।” গৌতম দাস বলেন, “দেখলাম গতকালও ভাসাচ্ছিল। কিন্তু পরে তুলে নিয়ে আবার রাতে মনসা পুজো করে। আবার দেখছি আজকে আবার ভাসানোর চেষ্টা করচ্ছে।” এদিন লালগড় থানার পুলিশ দেহটি উদ্ধার করে লালগড় ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যায়।
[কান্না থামাতে নাতির বুকে চাপ, শিশুকে খুনের অভিযোগে ধৃত দাদু]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.