নিজস্ব সংবাদদাতা, তেহট্ট: কালীপুজোর সময় শেষবার বাড়ি ফিরেছিলেন৷ এক ঝলক দেখে গিয়েছেন পুত্রসন্তানের মুখ৷ কথা দিয়েছিলেন দোলের সময় বাড়িতে আসবেন৷ দিনকয়েক বাবা, মা, স্ত্রী এবং শিশুপুত্রকে নিয়ে সময় কাটাবেন৷ তবে কথা রাখতে পারলেন না নদিয়ার হোগলবেড়িয়ার বালিয়াশিশার প্রসেনজিৎ বিশ্বাস৷ জওয়ানের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পাকিস্তানের দিক থেকে ছুটে আসা গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেল তাঁর শরীর৷ কফিনবন্দি হয়ে প্রসেনজিতের প্রাণহীন নিথর দেহ ফিরছে গ্রামের বাড়িতে৷
বালিয়াশিশা গ্রামেই ছোট থেকে বেড়ে ওঠে প্রসেনজিৎ৷ বাবা সৌমেন বিশ্বাসের একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি৷ পদ্মপুরাণের গান গেয়ে সংসার চালাতেন প্রসেনজিতের বাবা৷ খুব কষ্ট করে প্রসেনজিতের পড়াশোনার খরচ চালাতেন৷ গ্রামের স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলেও ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ সংসারের খরচ জোগাতে বাবাকে সাহায্য করতে দিনমজুরের কাজও করতেন প্রসেনজিৎ৷ যখন কলেজে ভরতি হওয়ার পর সেনাবাহিনীতে ডাক পেলেন, সংসারের কথা ভেবে চাকরির সুযোগ ফেরাননি৷ চলে গিয়েছিলেন উপত্যকায়৷ রাজৌরির সুন্দরবনি সেক্টরের ১২৬ নম্বর ব্যাটেলিয়ানের জওয়ান প্রসেনজিৎ বিয়ে করেছিলেন বছরখানেক আগে৷ মাসখানেকের সন্তানও রয়েছে তাঁর৷
বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজৌরিতে চলছিল সংঘর্ষবিরতি৷ তার মধ্যেই পাকিস্তানের দিক থেকে ধেয়ে এল গুলি৷ ঝাঁজরা হয়ে গেল প্রসেনজিতের দেহ৷ তবে সন্ধে পর্যন্ত বাবা, মা, স্ত্রী কেউই টের পাননি এত বড় বিপদের কথা৷ রাতের দিকে প্রসেনজিতের বাবার কাছে একটি ফোন আসে৷ জানতে পারেন প্রসেনজিৎ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন৷ মিনিট কুড়ি পর আবারও বেজে ওঠে ফোন৷ ততক্ষণে সব শেষ৷ খবর পান জীবনযুদ্ধে হার মেনেছেন তাঁর সেনা জওয়ান ছেলে৷
সন্তান হারানোর শোকে পাথর হয়ে গিয়েছেন প্রসেনজিতের বাবা৷ একই অবস্থা প্রসেনজিতের মা নন্দরানিরও৷ কাঁদতে কাঁদতে বেশ কয়েকবার অচৈতন্যও হয়ে গিয়েছেন তিনি৷ বুধবার সকালেই শেষবার ছেলের সঙ্গে কথা বলেন জওয়ানের মা৷ স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়েই মাসখানেকের শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে বাপের বাড়ি থেকে ছুটে আসেন প্রসেনজিতের স্ত্রী সুমনা৷ বিয়ের পরপরই শ্বশুরবাড়িতে রেখে জওয়ান স্বামী চলে গিয়েছিলেন সীমান্তে৷ নিয়মিত মেসেজেই কথা হত দু’জনের৷ কিন্তু বৃহস্পতিবার প্রসেনজিতের কোনও মেসেজ পাননি তিনি৷ অবাক হয়েছিলেন৷ এরপরই আচমকা স্বামীর মৃত্যুর খবরে ভেঙে পড়েছেন সুমনা৷ দোলের সময় প্রসেনজিতের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল, কাঁদতে কাঁদতে একই কথা বারবার বিড়বিড় করছিলেন সুমনা৷ ভাইয়ের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না প্রসেনজিতের একমাত্র দিদি রাখিও৷ খবর পেয়েই তিনি ছুটে আসেন বাপের বাড়িতে৷
প্রাণবন্ত সেই প্রসেনজিৎকে আর ফিরে পাবেন না কেউ৷ মন চাইছে না, তবু রূঢ় বাস্তব মানতে শুরু করেছেন তাঁর পরিজনেরা৷ রাতেই হয়তো ফিরবে জওয়ানের দেহ৷ তাই শুধু পরিবারই নয়, কফিনবন্দি দেহের অপেক্ষায় রাত জাগবে তাঁর ছোটবেলার গ্রাম হোগলবেড়িয়াও৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.