সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: নদীর ওপর থেকে জমাট বাঁধা বালি সরতেই কাঁসাইয়ের নদী গর্ভে দেখা মিলল জৈন স্থাপত্যের। পুরুলিয়ার আড়শা ব্লকের বেলডি গ্রাম পঞ্চায়েতের তুমা-ঝালদা এলাকায় কাঁসাই নদীর গর্ভে অপূর্ব গঠন শৈলী ভগ্ন গোলাকার অংশ জানান দিচ্ছে তা যেন দেউলেরই চিহ্ন।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রায় হঠাৎই নদী গর্ভে ওই স্থাপত্য নজরে আসায় এলাকায় হইচই বেঁধে যায়। তারপর শুক্রবার সেখানে লোকসংস্কৃতি গবেষক তথা জৈন সংস্কৃতি সংরক্ষক সুভাষ রায় গিয়ে তা নিরীক্ষণ করে জানিয়ে দেন, নদী গর্ভে থাকা পোড়া ইটের অংশ জৈন স্থাপত্য। যা দেখে মনে হচ্ছে জায়গাটি সম্ভবত একটি দেউলের অংশ! এরপরই স্থানীয় বাসিন্দারা নদীর গতিপথ বা জলের স্রোতকে অন্য দিকে ঠেলে সেখানে খননকার্য চালানোর দাবি জানাতে থাকেন। তাই এলাকার বাসিন্দারা জোট বেঁধে আগামী সোমবার বিডিওর দ্বারস্থ হচ্ছেন। তাঁদের সাহায্য করছে দেউলবেড়া দশগ্রাম মেলা কমিটি। সেই সঙ্গে এক ফুট জলের নিচে থাকা এই স্থাপত্যকে ঘিরে শুরু হয়েছে গবেষণাও। আসলে এই জেলায় অতীতে জৈনদের বাস ছিল। ফলে জেলার বিভিন্ন জায়গায় সেই আমলের দেউল ও মূর্তি পাওয়া যায়। তাছাড়া, আড়শার তুমা-ঝালদার এই কাঁসাই নদী থেকে দেউলঘাটার দূরত্ব দশ থেকে বারো কিলোমিটার। এই নদীর পাড়েই জৈনদের দু’টি দেউল ছিল। যা ১৯৯২ সালের বন্যায় ভেসে গিয়ে নদী গর্ভে তলিয়ে যায়। নদীর তলায় থাকা এই ভগ্ন গোলাকার অংশ যদি দেউল হয় তাহলে এখানে সেই সংখ্যাটা তিনে দাঁড়াবে বলে জানান এলাকার বাসিন্দারা। লোকসংস্কৃতি গবেষক সুভাষ রায় বলেন, “নদী গর্ভে যা দেখলাম তাতে মনে হচ্ছে দেউলের মাথার অংশ ভগ্ন গোলাকার। কিন্ত গঠনশৈলি চৌকো। যা দেউলঘাটার অনুরূপ। মূল দেউলের পরিমাপ প্রায় বর্গক্ষেত্রকার। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে আট ফুট বাই আট ফুট। জলস্তর থেকে দেউলের দেড় থেকে দু’ফট অংশ দৃশ্যমান। আমি নিশ্চিত এটি জৈন স্থাপত্যের নিদর্শন। এর নির্মাণকাল আনুমানিক নবম থেকে দশম শতাব্দী।”
আপাতত গবেষণায় উঠে আসছে, এই স্থাপত্য রেখ শিল্প শৈলিতে তৈরি। যা রয়েছে দেউলঘাটায়। তাহলে কি কাঁসাইয়ের গর্ভে আর এক দেউলঘাটা? জল্পনা কিন্তু চলছেই। তবে খননকার্যের আগে এখনই গবেষকরা তা বলতে নারাজ। লোকসংস্কৃতি গবেষকদের কথায়, পোড়া এই ইটগুলির পরিমাপ দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ন’ইঞ্চি বাই ছ’ইঞ্চি। কোনওটা অর্ধবৃত্তাকার, কোনওটা বর্গক্ষেত্রকার। কোনওটা আবার আয়তাকার। এই নদীর কাছ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের মূর্তি মিলেছিল। কয়েক বছর আগে পাওয়া যায় চামরধারী নারী মূর্তিও। এসবই কাঁসাইয়ের আশেপাশের গ্রামে রাখা রয়েছে। নদী এলাকায় একের পর এক এমন জৈন স্থাপত্যের নিদর্শনে স্থানীয় বাসিন্দার এই পুরাকীর্তি সংরক্ষণে দেউলবেড়া দশগ্রাম মেলা কমিটি তৈরি করেছে। তাঁরা যেমন এই এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তা তৈরি করেছেন, তেমনই এই স্হাপত্য সংরক্ষণে পথেও নেমেছেন। ওই কমিটির তরফে দেবীলাল মাহাতো বলেন, “আমরা সোমবারই ব্লক প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে জানাচ্ছি নদীর স্রোতকে অন্য পথে নিয়ে এখানে খননকার্য শুরু হোক। তাহলে হয়তো এই নদী এলাকায় আর একটি দেউল মিলতে পারে। আগে কাঁসাই পূর্ব দিকে বইত। এখন তার গতিপথ পশ্চিমে।” তবে এই নিদর্শনের খবর চাউর হতেই নদী বক্ষে গুপ্তধন আছে এমনও রটে যায়। তাই জলের ভিতরে ভাসতে থাকা পোড়া ইট রাতের অন্ধকারে চুরি যাচ্ছে!
ছবি : অমিত সিং দেও
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.