দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি: বিবিধের মাঝে যেন মিলন মহান। আক্ষরিক অর্থেই মহান মিলনক্ষেত্রে পরিণত হল উত্তরপাড়ার মাখলা মানিকতলা এলাকার পীরবাবার মেলা। মঙ্গলবার পৌষ সংক্রান্তিতে এই মেলায় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষ হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ভেদাভেদ ভুলে একে অপরকে কাছে টেনে নিল। সম্প্রীতির এক অনন্য নজির সৃষ্টি করল দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে এই দু’দিন ব্যাপী এই মেলার বুধবার ছিল শেষ দিন। পীরবাবার দরগাকে ঘিরেই এই মেলার সূচনা হয়। স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা হৃষিকেশ চট্টোপাধ্যায় জানান, প্রায় আড়াইশো বছরের এই দরগা। সেই সময় এই এলাকা দিয়ে সরস্বতী নদী বইত। বর্তমানে সেই নদী মজে গিয়ে তার আর কোনও অস্তিত্ব নেই। সেসময় এই এলাকায় যেহেতু প্রচুর ইটখোলা ছিল আর সেখানে প্রচুর সংখ্যক মুসলিম শ্রমিক কাজ করতেন। ফলে মুসলিম ধর্মের অনেক মানুষের বাস ছিল মানিকতলা এলাকায়। সেই সময় থেকেই হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এক সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে ওঠে যা আজও অটুট। এক ফকির মানিকতলার একটি বড় পুকুরের ধারে পীরবাবার দরগা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে মাটির ঢিবি দিয়েই এই দরগা তৈরি হয়। পরবর্তীকালে তা পাকাপাকিভাবে তৈরি হয়।
কথিত আছে সেই সময় এই সরস্বতী নদী দিয়ে নৌকা করে সওদাগররা ডানকুনি খাল হয়ে সাগরে বাণিজ্য করতে যেত। সাগরে বাণিজ্য করতে যাওয়ার পথে সওদাগররা মানিকতলায় এই পীরবাবার দরগায় সিন্নি চড়িয়ে যেতেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল পীরবাবার দরগায় সিন্নি চড়ালে ব্যবসায় সমৃদ্ধি ঘটবে। আজও বিশ্বাস, এই দরগায় এসে কেউ খালি হাতে ফেরত যান না। তাই বহু দূর দূরান্ত থেকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বহু মানুষ এই দরগায় ছুটে আসেন তাদের মনোস্কামনা পূরণের জন্য। কালের নিয়মে ইটখোলাগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কাজের সন্ধানে বহু মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ অন্যত্র চলে যান। ফলে এলাকায় মুসলিম জনসংখ্যা অনেকটাই কমে যায়। তাই এই পীরবাবার দরগাও ক্রমশ ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায়। কিন্তু সম্প্রতি মানিকতলা উন্নয়ন সমিতি ও এলাকার স্থানীয় হিন্দু ভাইয়েরা এই পীরবাবার দরগার সংস্কার করে তার নতুন রূপ দেন। বর্তমানে এই দরগার রক্ষণাবেক্ষণও এলাকার হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষই মিলেমিশে করেন।
তাই দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির নজির হিসেবে পৌষ সংক্রান্তিতে এই পীরবাবার দরগাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরের মতো এবছরও এলাকার মানুষ উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠেন। সারাদিন নাম গান কীর্তনের পাশাপাশি বহু মানুষ এখানে দুই দিন দরগায় সিন্নি চড়ান। বাতাসা হরির লুট দেওয়া হয়। পাশাপাশি মেলার শেষ দিন রাতে এখানে এলাকার কয়েক হাজার মানুষ খিচুড়ি ভোগ খান। এলাকার মানুষ জানান আজও তাঁরা বাড়ির কোনও শুভ অনুষ্ঠান বিয়ে, অন্নপ্রাশন, পৈতে হলে তার আগে তাঁরা এই দরগায় সিন্নি চড়িয়ে যান। তাই এই মেলার মধ্যে দিয়ে পীরবাবার দরগা যেন দুই সম্প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.