Advertisement
Advertisement

Breaking News

Medinipur Medical Saline Case

মেদিনীপুর মেডিক্যালে প্রসূতি মৃত্যু: উঁকি দিচ্ছে গাফিলতির দীর্ঘ এপিসোড? গাইনি ওটির আড়াই ঘণ্টাতেই লুকিয়ে রহস্য

মেদিনীপুর মেডিক্যাল কাণ্ডে প্রাণ গিয়েছে এক প্রসূতি ও সদ্যোজাতর।

Inner investigation of Medinipur Medical Saline Case

ফাইল ছবি

Published by: Sayani Sen
  • Posted:January 16, 2025 12:28 pm
  • Updated:January 16, 2025 12:30 pm  

সংবাদ প্রতিদিন ব্যুরো: মেদিনীপুর মেডিক‌্যাল কলেজে প্রসূতির মৃত্যু নিয়ে অন্তর্তদন্তের জেরে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর দপ্তরে একের পর এক চাঞ্চল‌্যকর নথি এবং বিস্ফোরক তথ‌্য এসে জমা পড়ছে। বুধবার এমনই এক ২০ পাতার নথিতে স্পষ্ট প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত যে চার সিনিয়র ডাক্তার ডিউটি থাকা সত্ত্বেও অনুপস্থিত ছিলেন, তাঁরা গাফিলতি ধামাচাপা দিতে গিয়ে বিস্তর অসঙ্গতির তথ‌্য জমা দিয়েছেন। বিশেষ করে যে ৫ প্রসূতির অস্ত্রোপচার নিয়ে রাজ‌্যজুড়ে বিতর্ক চলছে, তার মধ্যে দুজনের অস্ত্রোপচার শেষ হওয়ার ‘টাইম’ কার্যত একই দেখিয়েছেন এক অভিযুক্ত সহকারী প্রফেসর পদমর্যাদার চিকিৎসক।

হাসপাতালের গাইনি বিভাগের ওয়ান-সি ইউনিটের অপারেশন থিয়েটারের সরকারি ওই নথি বলছে, অস্ত্রোপচারের জেরে মৃত মামণি রুইদাস এবং বর্তমানে চিকিৎসাধীন নাসরিন খাতুন, দুজনেরই অপারেশন শেষ হয়েছে সওয়া একটার আশপাশে। নাসরিনের অপারেশন রাত ১.০৫-এ যেমন শেষ হয়েছে, তেমনই মামণি রুইদাসের অস্ত্রোপচার রাত ১.১৫ মিনিটে শেষ হয়েছে বলে নথিতে উল্লেখ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে এমন ঘটনা কার্যত অসম্ভব। কারণ, একই সময়ে দুজন প্রসূতিকে একই ডাক্তার একই অ‌্যাপ্রন পরে অস্ত্রোপচার করতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে সংক্রমণের যেমন আশঙ্কা থাকে, তেমনই পাশাপাশি দুটি টেবিলে একজন ডাক্তারের পক্ষে মনঃসংযোগ স্থির রেখে দুজন প্রসূতির সিজার ডেলিভারি করা যায় না।

Advertisement

কিন্তু ৮ জানুয়ারি, বুধবার রাতে মেদিনীপুর মেডিক‌্যালের ১সি ইউনিটের অপারেশন থিয়েটারে এমন ঘটনা ঘটেছিল বলে একদিকে যেমন নথি পাওয়া গিয়েছে, অন‌্যদিকে সিআইডির জেরায় স্বীকার করেছেন অস্ত্রোপচারে অংশ নেওয়া জুনিয়র ডাক্তাররা। বস্তুত, এমনই কলঙ্কজনক ও অবৈজ্ঞানিক অপারেশনের জেরে অকালে মৃত্যু হয়েছে মাত্র ২০ বছর বয়সি প্রসূতি মামণি রুইদাসের। আজ, ওই অস্ত্রোপচারে পৃথিবীর আলো দেখা শিশুপুত্র মাতৃহারা হল কাদের দোষে?মেদিনীপুর মেডিক‌্যালের নানা সূত্র থেকে পাওয়া প্রামাণ‌্য বিস্ফোরক তথ‌্য জানাচ্ছে, আড়াই ঘণ্টার রহস‌্য এবং ভয়ংকর গাফিলতির দীর্ঘ এপিসোড প্রসূতি মৃতু‌্যর অন‌্যতম কারণ। সিনিয়র স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা সাধারণ সিজার ডেলিভারিতে সময় নেন ৪০/৫০ মিনিট। কিন্তু যে ৫ প্রসূতিকে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল, তাঁদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই দু থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় নিয়েছিলেন অপরিপক্ব-অনভিজ্ঞ জুনিয়র ডাক্তাররা। চার সিনিয়র না আসায় সেই রাতে সিজার ডেলিভারিতে অংশ নেন প্রথম বর্ষের পিজিটি ডা. মৌমিতা, তৃতীয় বর্ষের পিজিটি ডা. ভাগ‌্যশ্রী এবং আরেক জুনিয়র ডাক্তার ডা. জাগৃতি ঘোষ।

আর অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও প্রসূতির কোমরে ইঞ্জেকশন নিয়ে গুঁতোগুঁতি করে অ‌্যানাস্থেটিস্টের কাজ করেছিলেন জুনিয়র ডাক্তার মণীশ প্রধান। তথ্যে পাওয়া গিয়েছে, বিশেষ করে অপারেশনের ধাক্কায় পরদিনই মারা যাওয়া মামণি রুইদাসের পেট চিরে প্রায় আড়াই ঘণ্টা খুলে রাখা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ঘটনা শুনে আঁতকে উঠে জানিয়েছেন, এভাবে প্রসূতির দেহ কাটা অবস্থায় খোলা থাকলে বাইরে থেকে ব‌্যাকটেরিয়া ঢুকে দেহে পচন ধরাতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। বস্তুত সেই কারণে, যে কোনও অপারেশনে শরীরের কাটাছেঁড়া অংশটাও অত‌্যন্ত যত্ন করে ঢেকে রাখা হয় এবং ঘনঘন ‘স্টেরিলাইজড’ যন্ত্রপাতি ব‌্যবহার করা হয়। কিন্তু সেদিন পুরোপুরি প্রসূতিদের শরীরের একটা বড় অংশ কাটা অবস্থায় খুলে রাখা হয়েছিল বলে অপারেশন থিয়েটারে উপস্থিত একাধিক জুনিয়র ডাক্তার ও নার্স স্বীকার করেছেন। স্বভাবতই প্রসূতির পেট কাটার পর এই আড়াই ঘণ্টার ‘ভয়ংকর’ পরিস্থিতি রোগীকে কার্যত ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল বলে মনে করছেন রাজ্যের প্রবীণ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা।

অন্তর্তদন্তে ধরা পড়েছে, শুধুমাত্র আড়াই ঘণ্টা ধরে খোলা ফেলে রাখা নয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একই অ‌্যাপ্রন পরে দুজন প্রসূতিকে অস্ত্রোপচার করেছেন এক জুনিয়র ডাক্তার। কলকাতার পিজি হাসপাতালের গাইনি বিভাগের এক প্রাক্তন প্রধান জানিয়েছেন, পেট কাটা অবস্থায় দু’বার ব‌্যবহার করা অ‌্যাপ্রন থেকেও শরীরে ভয়ংকর-ইনফেকশন ঢুকে পড়তে পারে। যা পরের কয়েক ঘণ্টায় প্রসূতির শরীরে খিঁচুনি সৃষ্টি করে রোগীকে মৃতু‌্য পথযাত্রী করে তুলতে পারে। আর সেই কারণে, অপারেশন থিয়েটারে ওই আড়াই ঘণ্টার ভয়ংকর রহস‌্য এবং তার ‘মেডিক‌্যাল-টেকনিক‌্যাল’ দিক জানতে মরিয়া সিআইডি’র গোয়েন্দারা। মেদিনীপুর মেডিক‌্যালে ঘটনার রাতে রোস্টারে ডিউটি থাকা সিনিয়র চার চিকিৎসক ডা. দিলীপ পাল, ডা. সৌমেন দাস, ডা. হিমাদ্রি নায়েক এবং অ‌্যানাস্থেটিস্ট পল্লবী বন্দ্যোপাধ‌্যায় অনুপস্থিত থাকায় প্রসূতিদের অস্ত্রোপচারে বাধ‌্য হন গাইনি ওয়ার্ডে নাইট ডিউটিতে আসা ৫ জুনিয়র চিকিৎসক। এঁদের মধ্যে প্রথম বর্ষের পিজিটি ডা. মণীশ প্রধান প্রসূতিদের মেরুদণ্ডে ইঞ্জেকশন দিয়ে অ‌্যানাস্থেশিয়া দিয়েছিলেন। স্বাস্থ‌্য দপ্তর ও সিআইডিকে জমা দেওয়া সরকারি নথিতে ডিউটি না-আসা সত্ত্বেও বেড টিকিট ইনচার্জ ডা. দিলীপ পাল তাঁর রিপোর্টের দ্বিতীয় পাতায় স্বীকার করেছেন, প্রথম প্রসূতি মিনারা বিবির মেরুদণ্ডে একাধিকবার ফুঁড়িয়ে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে।

প্রত‌্যক্ষদর্শীরা ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর অন্তর্তদন্তকারীদের কাছে স্বীকার করেছেন, মাত্র একবারেই যেখানে মেরুদণ্ডের কশেরুকা ভেদ করে চেতনানাশক রাসায়নিক ‘সেরিব্রো স্পাইনাল ফ্লুইডে’ মিশিয়ে দেওয়ার কথা, সেখানে অন্তত তিন-তিনবার ফুটিয়ে ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন ওই জুনিয়র ডাক্তার। বস্তুত, এমনভাবে একাধিকবার মেরুদণ্ডে ইঞ্জেকশনের ধাক্কা লাগায় রোগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মামণি রুইদাসের অস্ত্রোপচারের সময় ভিতরে যে অন‌্য আরও এক প্রসূতিরও অপারেশন চলছিল, সে কথা এদিন সিআইডির গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন মামণি রুইদাসের স্বামী দেবাশিস এবং ননদ রুম্পা দাস।

আর এখানেই প্রশ্ন, কীভাবে একই অপারেশন ইউনিটে মাত্র চারজন জুনিয়র চিকিৎসক দু-দুটি অপারেশন করতে পারেন? ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর দপ্তরে আসা চাঞ্চল‌্যকর এবং বিস্ফোরক তথ‌্য হল, ডিউটিতে না-থাকা সত্ত্বেও যে সহকারী প্রফেসর পাঁচ প্রসূতির অস্ত্রোপচার নিয়ে একটি মনগড়া ২০ পাতার রিপোর্ট জমা করেছেন, সেখানে অজস্র অসংগতি রয়েছে। স্বাস্থ‌্য দপ্তরের এক শীর্ষকর্তা জানিয়েছেন, তড়িঘড়ি ‘তথ্যে জল মিশিয়ে বানানো’ এই ভুয়ো, লোক দেখানো ২০ পাতার রিপোর্টই ওই চার সিনিয়র চিকিৎসকের গাফিলতি প্রমাণের জন‌্য যথেষ্ট। কারণ, প্রসূতির হাসপাতালের ভর্তির সময় এবং অপারেশনের তথ‌্য লিখতে গিয়ে বহু অসঙ্গতি ফুটে উঠেছে ওই রিপোর্টে। আর এখানেই প্রশ্ন, যাঁদের গাফিলতি এবং অপরিণামদর্শী পদক্ষেপের জন‌্য এক প্রসূতির মৃত্যু হল, তিন প্রসূতি এখনও কলকাতার পিজি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, তাঁদের কি আর চিকিৎসা জগতে থাকার অধিকার আছে? উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement