নন্দন দত্ত, সিউড়ি: কাকা গোপীনাথ ওরাও নিজের হাতে কোদাল দিয়ে ল’ডিহির মাঠের মাটি পরিষ্কার করছেন। জ্যেঠিমা আরতি ওরাও উত্তর-দক্ষিণে কীভাবে শায়িত হবে তাঁদের রাজেশ, সেই তদারকিতে ব্যস্ত। বুধবারের মহম্মদবাজারের বেলগড়িয়া গ্রাম এভাবেই শোকের পাশাপাশি গর্বেও ভরপুর ছিল। চিন-ভারত (Indo-China) সীমান্ত যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন বাংলার ছেলে রাজেশ ওরাও। কথা ছিল, লাদাখ থেকে ফিরেই বিয়ে করার। সেইমতো বাড়িতে শুরুও হয়ে গিয়েছিল বিয়ের প্রস্তুতি। কিন্তু তা আর হল কই! বুধবার গ্রামের সেই বীর ছেলের জন্য সমাধিস্থল তৈরি করছিলেন পরিবারের সদস্যরা।
মহম্মদবাজারের ভূতুরা পঞ্চায়েতের এই আদিবাসী পরিবারের ছেলে রাজেশ ওরাও ছিল এলাকার কাছে এক অনুপ্রেরণা। ২০১৫ সালে শেওড়াকুড়ি বংশীধর উচ্চবিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেই সেনাবাহিনীর বিহার ব্যাটিলিয়ানে যোগ দেন রাজেশ। স্বপ্ন ছিল, দিনমজুর বাবা সুভাষ এবং মা মমতাকে একটু সুখ, শান্তি-স্বচ্ছন্দে রাখার। চেষ্টাও করেছেন। তাই ২৬টি বাড়ির বেলগড়িয়া গ্রামের একমাত্র পাকা বাড়ি রাজেশদেরই। এলাকায় একমাত্র সরকারি চাকুরেও রাজেশ। মা মমতা ছেলের ছবি বুকে নিয়ে কেঁদেই চলেছেন হাপুঁস নয়নে।
রাজেশের মা বলছিলেন, আমার কোনও কষ্ট রাখতে চায়নি আমার একমাত্র ছেলে। দিন সাতেক আগে ছোট মেয়ে শকুন্তলাকে নিয়ে যখন ব্যাংকে গিয়েছিলেন তখনই শেষ কথা হয়েছিল ছেলের সঙ্গে। বলেছিলেন, “মা যা মন চায় তুমি কিনে নাও। তুমি আর বাবা সুখে থাকো।” সেই ছেলেই দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। মৃত্যুর পরও তাঁকে যেন মনে রাখে সবাই, শ্রদ্ধা জানাতে তাই গ্রামে ঢুকতেই ল’ডিহির মাঠে নিজের হাতে শহিদ-বেদ করছেন জ্যেঠিমা, কাকা-সহ গ্রামের যুবকেরা।
গ্রামবাসী বামি ওরাও বললেন, “ছেলেটা গ্রামে এলে যে গ্রামটা জেগে উঠত! সবাইকে নিয়ে খেলা, হাসি-ঠাট্টা, গল্পে মশগুল থাকত দিনরাত। গতবার সরস্বতী পুজোয় শেষ এসেছিল গ্রামে। জ্যেঠতুতো ভাই অভিজিৎ বলছিলেন, এবার বাড়ি ফেরার কথা ছিল রাজেশের। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, আত্মীয়দের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার। শেষবার যখন ফোনে আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল, শুধু বলেছিল, ‘বাবা, মা, বুনিকে দেখিস।’ কিন্তু ও যে এভাবে দায়িত্ব দিয়ে চলে যাবে ভাবিনি কখনও।”
বুধবার সকাল থেকেই গ্রামে পুলিশকর্তা থেকে প্রশাসনিক কর্তাদের গাড়ি যাতায়াত করছে। শহিদ জওয়ানের দেহ যাতে কাদাময় রাস্তায় আসতে অসুবিধা না হয় তার জন্য গোটা গ্রামের রাস্তাজুড়ে ফেলা হচ্ছিল পাথরের ডাস্ট। স্থানীয় ব্যবসায়ী মীর ফিরোজ আহমেদ ওরফে টমাশ তার দেখভাল করছিলেন। আদিবাসী গাঁওতার নেতা রবীন সোরেন বললেন, “সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পরেও রাজেশ ছিল তাঁদের সংগঠনের একজন কর্মী। গ্রামোন্নয়নে তাঁর অবদান কোনওদিন কোনও অংশে কমেনি।” গ্রামের মানুষ জানিয়েছে, তাদের প্রথায় কোনও কোনও ব্যক্তিকে গ্রামের বাইরে শংকর নদীর ধারে দাহ করা হয়। কাউকে আবার সমাধিস্থও করার রীতি রয়েছে। রাজেশের বাবা-মা এবং পরিবারের সদস্যরা চেয়েছেন, তাঁদের ছেলে তাঁদের গ্রামেই শায়িত থাক। তাই রাজেশ ওরাংয়ের জন্য নিজের জমিতেই গড়ে উঠছে শহিদবেদি।
মঙ্গলবার সেনাবাহিনীর তরফে মৃত্যুসংবাদ জানানোর পর শোকাহত বাবা সুভাষ ওরাং অস্ফুটে একটাই কথা বলেছিলেন, “ছেলের মৃত্যুর বদলা চাই।” বলামাত্রই সেনাবাহিনীর পোশাকে তোলা ছেলের ছবি ধরে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.