সুলয়া সিংহ, বর্ধমান: ফুল ফুটুক না ফুটুক, এখানে আজ বসন্ত। এখানে আজই প্রেমের দিন। ভালবাসাবাসির সূচনা। প্রতিষ্ঠানের বেড়াজাল বছরের অন্য সময়ে। আজ সব বিধিনিষেধ ছিঁড়ে ফেলার পালা। একে অন্যের কাছে ছুটে যাওয়ার অন্তহীন আকর্ষণ। হাতে রাখা তত্ত্বের থালায় গোপন চিঠিতে লেখা সেই আকর্ষণের কথা। দেখা হবেই তাঁর সঙ্গে। সরস্বতী পুজো অর্থাৎ বাঙালির অঘোষিত প্রেমদিবসের পরদিন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্লস এবং বয়েজ হস্টেলের মধ্যে তত্ত্ব আদানপ্রদান প্রাচীন একটি রীতি। আর সেই রীতির হাত ধরেই এই মাঘে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নেমে আসে অকাল বসন্ত। একটি মন ছুঁয়ে যায় আরেকটি মন।
বিদ্যাং দেহি। বসন্তপঞ্চমীতে দেবী সরস্বতীর কাছে শুধু কি এই প্রার্থনা করেই ক্ষান্ত থাকেন না ছাত্রছাত্রীরা। মনের গোপনে লুকিয়ে রাখা একান্ত ইচ্ছেটিও আজকের দিনে প্রকাশ করে দেয় সদ্য যৌবনে পা রাখা ছাত্র বা ছাত্রীরা। মনে মনে অনেকেই হয়ত বলেন, ‘আজ যেন ওর সঙ্গে দেখা হয়।’ কিংবা ‘আজ যেন ওকে মনের কথাটা বলে দিতে পারি।’ এই কথা দেওয়ানেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আবাসের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায় ছাত্রদের জন্য আর ছাত্রাবাসের গেটের বাইরে অসংখ্য ছাত্রীর ভিড়। খালি হাতে নয়, পছন্দের মানুষটির মন জয় করে নিতে প্রত্যেকের হাতে তত্ত্বের ডালি। তাতে ফল, মিষ্টি, চকলেটের ফাঁকে গোপন চিঠি – প্রেম প্রস্তাব!
চিরাচরিত জিন্স-টপ, সালোয়ার-কুর্তা ছেড়ে মেয়েদের পরনে আজ রঙিন শাড়ি, এলোচুল কিংবা খোঁপায় ফুল। ছেলেরাই বা কম কীসে? পাঞ্জাবি-পাজামায় দিব্যি পরিণত বয়স্কদের মতো আপ্যায়ণের ব্যস্ততা শরীরী ভাষায়। এদিন প্রথমে ছাত্রদের হস্টেল থেকে ফল,মিষ্টি, চিপস, চকলেটে ভরা তত্ত্বের থালা পৌঁছে যায় নিবেদিতা, সরোজিনী হস্টেলে। এই দিনটায় গার্লস হস্টেলের গেটে তাঁদের বাধা দেওয়ার জন্য কেউ থাকে না। ওদের হাত থেকে তত্ত্ব গ্রহণ করে আড়চোখে দেখে নেওয়া পছন্দের পুরুষটিকে। আর তারপর, রাত জেগে নিজেদের সাজানো তত্ত্ব নিয়ে মেয়ের দল পৌঁছে যায় অরবিন্দ বা রবীন্দ্র হস্টেলে। সঙ্গে শঙ্খ, ঢাক। রাস্তায় সে এক দেখার মতো দৃশ্য বইকি। অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়ে পথ ছেড়ে দেন ছাত্রীদের। তত্ত্ব সাজানো আর আলপনা আঁকা, এই দুই কাজে ছাত্রছাত্রীরা একে অপরকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। অলিখিত এই প্রতিযোগিতার মাঝে যেন বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। প্রেমিকা তত্ব সাজানোয় জিতে গেলে, প্রেমিকের হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হয়ে ওঠে যেন।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সরস্বতী পুজোয় যদি এই তত্ত্ব আদানপ্রদানের রীতিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা যায়, তাহলে চমক অবশ্যই প্রতিটি হস্টেলে পৃথক পৃথক বাণীবন্দনা। তাতে থিমের ছড়াছড়ি। কোনও শিল্পীর সাহায্য নয়, নিজেদের হাতেই থিমের মণ্ডপ গড়ে তোলেন ছাত্রছাত্রীরা। যেমন এবছর অরণ্য সংরক্ষণ থিমকে সামনে রেখে আমাজনের অগ্নিকাণ্ড, অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের ক্ষতিকে তুলে ধরে মণ্ডপ সাজিয়েছে একটি ছাত্রাবাস। কোথাও আবার সাবেকি মণ্ডপ। তার সামনে যেন বাসন্তী রঙা শাড়ির মেলা। এভাবেই মা সরস্বতীকে সাক্ষী রেখে ভালবাসার অর্ঘ্যরচনা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রেমপর্ব আবহমান কাল ধরে চলছে, চলবেও।
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.