সুমিত বিশ্বাস: “শুন বিহারী ভাই/তোরা রাখতে নারবি ভাঙ দেখাই/তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি/বাংলা ভাষায় দিলি ছাই৷”
পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি দিবস, ১ নভেম্বর এলেই সাবেক মানভূম তথা পুরুলিয়া লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের মানুষজন ক্ষোভ, আক্ষেপে এই টুসুগান আওড়ান৷ মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে সাবেক মানভূমে সেনানীদের আরও উজ্জীবিত করতে এই টুসু গান বাঁধেন লোকসেবক সংঘের সদস্য তথা প্রয়াত সাংসদ ভজহরি মাহাতো৷ এই টুসু গানই ছিল ভাষা আন্দোলনের হাতিয়ার৷ গানের সুরে-সুরে ভাষা আন্দোলন পুরুলিয়ার মানুষজন তাঁদের মাতৃভাষার অধিকার পান৷
১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর পুরুলিয়ার জন্ম হয়ে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্তি হয়৷ কিন্তু সাবেক মানভূমের একটা বড় অংশ সেই সময় বিহারে থেকে যায়৷ যা বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের অধীনে৷ ফলে বোকারোচাষ, চন্দনকেয়ারি পূর্ব সিংভূমের পটমদা, চাণ্ডিল, ইচাগড়ের বাঙালিদের ১ নভেম্বর এলেই মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়৷ বাংলায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার যন্ত্রণা তাঁদের কুরে কুরে খায়৷ তাই সাবেক মানভূমের ঝাড়খণ্ডের বাঙালিরা বাংলায় অন্তর্ভুক্ত হতে স্লোগান তোলেন৷ সেই ভাষা আন্দোলনের সেনানী পটমদা থানার কুমিরের বাসিন্দা সর্বেশ্বর মাহাতো বলেন, “তৎকালীন কংগ্রেস সরকার চক্রান্ত করে সাবেক মানভূমের এই অংশকে বিহারে রেখে দেয়৷ তাই আজ ঝাড়খণ্ডের মানুষজন মাতৃভাষার স্বাদ পেতে স্লোগান তোলেন৷”
সাবেক মানভূমে থাকা পুরুলিয়ার বঙ্গে অন্তর্ভুক্তি হলেও এই ভাষা আন্দোলন আজও উপেক্ষিত৷ ৬১তম বঙ্গভুক্তি দিবসেও সরকার পুরুলিয়ার জন্মদিনে কোনও অনুষ্ঠান করে না৷ বাম সরকার ভাষা সেনানীদের সম্মানে যে স্মারক স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করে, তা আজও সম্পূর্ণ হয়নি৷ বঙ্গভুক্তি দিবসের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে গত ২০০৬ সালে পুঞ্চার পাকবিড়রায় এই স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ কিন্তু তা আজ ব্রাত্য হয়েই পড়ে রয়েছে৷ যেমনভাবে ভাষা সেনানীদের অবহেলায়, অর্ধাহারে দিন কাটে, তেমনই একই অবস্থা স্মারকস্তম্ভের৷
ওই আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতেই ভাষা সেনানীরা দাবি তোলেন, ভাষা আন্দোলনের এই ইতিহাস স্কুলপাঠ্যে তুলে ধরতে হবে৷ সেই থেকে গত দশ বছর ধরে ওই দাবিতে স্লোগান তুলে আসছেন মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে আন্দোলন করা লোকসবেক সংঘ তথা ভাষা সেনানীরা৷ যদিও পুরুলিয়ার সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজগুলিতে ইতিহাস বিভাগে পাস কোর্সে ও অনার্সে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে৷ কিন্তু ভাষা সেনানী সুচাঁদ মাহাতো মনে করেন, ‘‘এটা আমাদের কোনওভাবে সন্তুষ্ট করতে করা হয়েছে৷ আমরা চাই স্কুলপাঠ্যে এই ইতিহাস পড়ানো হোক৷”
কারণ, এই জেলার নয়া প্রজন্ম সেভাবে পুরুলিয়ার এই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানেন না৷ মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে ভাষা আন্দোলন যখন জোরদার হচ্ছে সাবেক মানভূমে৷ সেই সময় ১৯৫৬ সালে সীমা কমিশন কেন্দ্রকে রিপোর্ট দেয় সমগ্র মানভূমের মাতৃভাষা বাংলা৷ তার পরেও তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা-বিহারের সঙ্গে কথা বলে দুই রাজ্যের সংযুক্তিকরণের পথে হাঁটেন৷
তার পরই ১৯৫৬ সালের ২০ এপ্রিল পুঞ্চার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে ১০২৫ জন ভাষা সেনানী কলকাতা অভিযান করেন৷ তাঁদের দাবি ছিল সাবেক মানভূমের সমগ্র অংশকে বাংলার অন্তর্ভুক্তি৷ সেই দাবিতে কলকাতার ধর্মতলায় আইন অমান্য হয়৷ পুরুলিয়ার মা হিসাবে পরিচিত লাবণ্যপ্রভা দেবী ও তাঁর স্বামী তথা লোকসেবক সংঘের তৎকালীন সভাপতি অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে এই পদযাত্রা হয়৷ এই পদযাত্রার পরে ৯ মে আইন অমান্য করে ৯৬৫ জন কারাবরণ করেন৷ তারপরেই জন্ম হয় এই জেলার৷ পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি হয়৷ সরকার বা প্রশাসনের তরফে এই জন্মদিন পালন না হলেও আজ মঙ্গলবার পুরুলিয়া শহরের ঋষি নিবারণ চন্দ্র মূর্তির পাদদেশে লোকসেবক সংঘ ৬১তম বঙ্গভুক্তি দিবস উদযাপন করবে৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.