শুভময় মণ্ডল: সাম্প্রদায়িক অশান্তিতে নাবালক পুত্রকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছেন তিনি৷ তবু, পুত্রশোক তাঁকে ইসলামের স্বরূপ থেকে বিচ্যুত করেনি৷ মর্মান্তিক বেদনা বুকে চেপে শুনিয়েছেন শান্তির বার্তা৷ আজ যখন নির্বাচনী অশান্তির আশঙ্কা আরও একবার দেখা দিয়েছে বাংলায়, তখনও সেই অহিংসাকেই পাথেয় করছেন আপন আদর্শে নিষ্ঠ মানুষটি৷ তিনি মহম্মদ ইমদাদউল্লাহ রশিদি৷ আসানসোলের নূরানি মসজিদের ইমাম৷ রশিদি বলছেন, দেশজুড়ে ঘৃণার বাতাবরণ দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে৷ ধর্মে-ধর্মে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্যের অভাব প্রকট হচ্ছে৷ প্রেমের আবহ ছড়িয়ে পড়ুক দেশে, শান্তিতে থাকুন দেশবাসী৷
বছর খানেক আগে রামনবমীর মিছিল ঘিরে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে প্রাণ গিয়েছিল ইমামের নাবালক ছেলে মহম্মদ শিবঘাতুল্লার৷ নিতান্তই দু’পক্ষের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে নিহত হয় বছর ষোলর ছেলেটি৷ এমন ঘটনায় স্বভাবতই স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা উসকে ওঠে৷ রে রে করে তারাও পালটা আক্রমণের পথে হাঁটতে চান৷ কিন্তু রুখে দাঁড়ান সদ্য পুত্রহারা ইমাম রশিদি৷ এমন সংকটকালেও একা গলা তুলে কার্যত নির্দেশ দেন, ‘কোনও প্রতিশোধের পথে হাঁটবে না কেউ৷ এই মুহূর্তে এলাকায় শান্তি বজায় রাখা জরুরি৷’ একমাত্র ইমামের কথায় সেদিনের মতো বড়সড় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল আসানসোল। শুধু আসানসোল নয়, বলা ভাল গোটা বাংলাই৷ আর ওই পরিস্থিতিতে একেবারে ব্যতিক্রমী বার্তা দিয়ে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিলেন ইমাম ইমদাদউল্লাহ রশিদি৷
সেই ঘটনার পর এক বছর কেটে গিয়েছে৷ আসানসোল তথা রাজ্যের পরিস্থিতি পালটেছে অনেক৷ এসে গিয়েছে লোকসভা নির্বাচন৷ এই সময় দাঁড়িয়েও ইমাম তাঁর আদর্শে মেরুদণ্ড ঋজু রেখে দিয়ে চলেছেন শান্তির বার্তা৷ বলছেন, ‘যা হয়ে গেছে, তা ভুলে যেতে হবে৷ নতুন করে জীবন শুরু হয়েছে৷ সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই পারস্পরিক ভালবাসা, আস্থার জায়গা থাকা উচিৎ৷ সব ধর্ম তার নিজের ভাল দিকগুলি ছড়িয়ে দিক৷ এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের ভালবাসার বন্ধন আরও দৃঢ় হোক৷’ কথায় কথায় জানা গেল, তিনি ছেলে শিবঘাতুল্লার নামে একটি স্কুল খুলতে চান এলাকায়৷ সেখানে সর্বধর্মে সমন্বয়ের বাতাবরণ থাকবে৷ পড়ুয়াদের মধ্যে সম্প্রীতির পাঠ দেবেন৷
এবার আসা গেল আসল কথায়৷ ‘এই পরিস্থিতির পর ভোট দেবেন? কী ভাবছেন?’- এই প্রশ্নের জবাবে স্বভাবসুলভ শান্ত সুরেই ইমাম জানালেন, প্রতিটি নাগরিকের অধিকার ভোট দেওয়া৷ সেই নাগরিক অধিকার পালন করা উচিৎ৷ একজন নাগরিক হিসেবে তিনিও নিজের কর্তব্য করবেন৷ কিন্তু কাকে সরকারে চাইছেন? কেমন সরকারই বা প্রত্যাশিত? রশিদি বলছেন, ‘সরকার যে-ই গঠন করুক, তারা যেন সহিষ্ণুতার বার্তা দেন৷ প্রেম, সম্প্রীতি ছড়িয়ে দেন দেশজুড়ে৷ নাহলে দেশ পিছিয়ে পড়বে৷’ ইমামের এসব কথা থেকেই স্পষ্ট, তিনি দিতে চাইলেন সহিষ্ণুতার বার্তা৷ আসানসোলের নূরানি মসজিদের ইমামই এখন এলাকার সবচেয়ে বড় শান্তির প্রতীক, এলাকাবাসীর আদর্শ, অনুপ্রেরণা৷ ইমাম রশিদির সংস্পর্শে থেকে তাঁরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছেন, প্রতিশোধস্পৃহার জোর ততটা নেই, যতটা আছে সংযত আচরণের মধ্যে৷ যতটা আছে দুঃসহ স্মৃতি ভুলে যাওয়ার মধ্যে৷ তাই তাঁরা বলছেন, ‘আমরা বেশ শান্তিতেই আছি৷’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.