ছবি: সুনীতা সিং।
সুমিত বিশ্বাস, চাকলতোড় (পুরুলিয়া): ছাপোষা গাঁয়ের বধূ। অজ পাড়া গাঁয়ের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। সেই ‘ঘরের মেয়ে’ এবার বসলেন পুরুলিয়া (Purulia) জেলা পরিষদের সভাধিপতির কুরসিতে। সোমবার থেকে তাঁর সঙ্গী একাধিক রক্ষী, এসকর্ট, বাংলো। ঝাঁ-চকচকে অফিস, গাড়ি। নিবেদিতা মাহাতো। সোমবার থেকে জীবনযাত্রাই পালটে গেল তাঁর। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কাজ থেকে ছুটি, এখন দায়িত্ব আরও বড়। আর তাই শপথ গ্রহণের আগেই ঠিক করে নিয়েছেন, পানীয় জলের সমস্যা মেটানোই তাঁর অগ্রাধিকার।
পুরুলিয়া এক নম্বর ব্লকের চাকলতোড় গ্রাম পঞ্চায়েতের (Gram Panchayat) পদুডি গ্রামের বাসিন্দা। এখান থেকে প্রায় কম-বেশি তিন কিমি দূরে তাঁর কর্মস্থল ওই গ্রাম পঞ্চায়েতেরই দাঁন্দুডি অঙ্গনওয়াড়ি (ICDS Centre) কেন্দ্র। যা আজও ভবন হয়নি। তাই দাঁন্দুডি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলে ওই কেন্দ্র। ফি দিন সকালেই একপ্রস্থ হেঁশেল সামলে স্বামীর সঙ্গে স্কুটিতে করে কর্মস্থলে নিজের কেন্দ্রে আসা। এখানে শিশুদের পাঠদান, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রসূতিদের স্বাস্থ্যের খোঁজ নেওয়া। শিশুদের পাতে পুষ্টিকর খাবার পড়ছে কিনা, তার নজরদারি করা। কোন শিশুর ওজন কমল, কেউ রক্তাল্পতায় ভুগছে না তো? এই সব খুঁটিয়ে দেখে প্রায় দু’ঘন্টা কেন্দ্রে কাটিয়ে বাড়ি গিয়ে আবার সংসারের হাল ধরা। একান্নবর্তী পরিবার। তাই কাজের চাপও বেশি। কিন্তু সব সামলে সভাধিপতির কুরসিতে বসা সহজ ছিল না বছর চল্লিশের নিবেদিতার। দু’ দুবার পুরুলিয়া জেলা পরিষদের (Zilla Parishad)সাধারণ সদস্য হওয়ার পরেও এবার চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় তাঁর নাম পর্যন্ত ছিল না।
কিন্তু হঠাৎই মোড় ঘুরে গেল। দলের নির্দেশেই মনোনয়ন জমা করলেন তিনি। পুরুলিয়া এক নম্বর ব্লকের ৯ নম্বর আসনে তিনি মনোনয়ন জমা করলেও দলেরই এক জেলা নেতা গোঁজ হয়েছিলেন। যদিও তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। এই পরিস্থিতিতে বিজেপির সঙ্গে লড়াই করে দু’বারের চেয়ে বেশি ৬,১৯৫ ভোটে জয় পান তিনি। গতবারে তাঁর জয়ের মার্জিন ছিল প্রায় চার হাজার। এই জয়ের মার্জিন থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় সাধারণ মানুষেরও মন জিতেছেন তিনি। কিন্তু নিবেদিতা বলেন, “অবিশ্বাস্য! অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী থেকে সভাধিপতি ভাবতেই পারছি না। মনে হচ্ছে কোন ঘোরে নেই তো।”
প্রশাসনিক কাজে আনকোরা হলেও রাজনীতিতে তিনি এখন অনেকটাই দক্ষ। তাই কথাবার্তাও বেশ চৌখস। আর পাঁচটা রাজনীতিকদের মতনই। তাই তো কাজের অগ্রাধিকারের প্রশ্ন করতেই বললেন, “এই খরা কবলিত জেলার পানীয় জলের সমস্যা মেটানোই এখন তাঁর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।” আসলে এই জেলায় আজও যে বহু মানুষকে নদীর বালি খুঁড়ে বা ঝোরার কাছে দাঁড়ি (মাটি খুঁড়ে জল) থেকে মাথায় করে জল আনতে হয়। গাঁয়ের বধূ তাই মহিলাদের এই কষ্টটা ভালভাবেই বোঝেন নিবেদিতা। উন্নয়নের কাজ কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন? সঙ্গে সঙ্গে সোজাসাপটা উত্তর “সকলের সঙ্গে মিলেমিশে মতামত নিয়ে কাজ করব। অন্যান্য অভিজ্ঞতাকে তো কাজে লাগাতেই হবে।”
আসলে রাজনীতির পরিমণ্ডলেই বড় হয়ে ওঠা এই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর। ঝালদা দু’নম্বর ব্লকের বামনিয়া-বেলাডি গ্রাম পঞ্চায়েতের পাড়ুয়া গ্রামে বড় হয়ে ওঠেন। ঝালদা অচ্ছুরাম কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক। বাবা বৃন্দাবন মাহাতো ছিলেন শিক্ষক, ঝালদা ২ পঞ্চায়েত সমিতির কংগ্রেসের সদস্য। বিয়ে হয়ে পদুডি গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে আসার পর মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। শ্বশুরবাড়িতেও রাজনীতির আবহ। করাডি হাই স্কুলের শিক্ষক বলরাম মাহাতো পুরুলিয়া ১ নম্বর ব্লকের কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন প্রায় দেড় দশক। ১৯৭৮ সালে গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান। তারপর পুরুলিয়া এক পঞ্চায়েত সমিতির দু’দুবারের সদস্য, সেইসঙ্গে কর্মাধ্যক্ষ। স্বামী চাকলতোড় অঞ্চল তৃণমূলের সভাপতি। তিনি নিজেও মহিলা জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক। ফলে রাজনীতির মারপ্যাঁচ, কৌশল তাঁর জানা।
তাঁর কথায়, “দল আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে তা ভালোভাবে পালন করাই এখন আমার প্রধান কাজ। এই জায়গায় পৌঁছনোর পিছনে শ্বশুর মশাইয়ের ভূমিকা অনেক। তিনি আজ নেই। কিন্তু তাঁর কথা বারেবারে মনে হচ্ছে। আজ এই দিনটা দেখলে তিনি খুব খুশি হতেন। তবে স্বামী যেভাবে আমাকে সব কাজে সাহায্য করেন। উৎসাহ দেন। সেজন্য আমিও এগিয়ে যেতে পারি।”
নিবেদিতার স্বামী উৎপলকুমার মাহাতো বলেন, “মাটি কামড়ে পড়ে থাকার দাম পেল নিবেদিতা। এখানে পৌঁছনো সত্যি সহজ ছিল না।” সভাধিপতির প্রাক্তন সহকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সহায়িকা দীপালি কুইরি বলেন, “দিদিকে ছেড়ে দিতে হবে তা ভাবতেই পারছি না। চোখে জল চলে আসছে। তবে দিদির যে এখন অনেক বড় দায়িত্ব। আমরা যে কি খুশি বোঝাতে পারবো না।” এবার নিজের হাত ধরে জেলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে অঙ্গনওয়াড়ির ক্লাসের ছুটি। সভাধিপতির কুরসিতে প্রটোকলে আবর্তিত রাষ্ট্রমন্ত্রীর মর্যাদা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.