সন্দীপ মজুমদার,উলুবেড়িয়া: বিভিন্ন চিড়িয়াখানা, অভয়ারণ্য ও রসায়নাগারে যখন ভিন্ন প্রজাতির দুই প্রাণীর মধ্যে মিলন ঘটিয়ে নতুন ধরনের বর্ণসংকর প্রাণী আবিষ্কারের বিষয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে, ঠিক তখনই হাওড়া জেলার আমতা এলাকায় রাস্তার কুকুর ও জঙ্গলের শিয়ালের মধ্যে মিলনের ফলে জন্ম নিল নতুন বর্ণসংকর প্রাণী। এমনই চাঞ্চল্যকর দাবি জানিয়েছেন পেশায় শিক্ষক এবং বন্যপ্রাণ নিয়ে কাজ করা বিশিষ্ট আলোকচিত্রী অম্বর চক্রবর্তী।
তিনি জানিয়েছেন, আমতা থানার নারিটে এই বর্ণসংকর প্রাণীর দেখা মিলেছে। যা দেখতে কিছুটা কুকুর এবং কিছুটা শিয়ালের মতো। এই অদ্ভুতদর্শন প্রাণীরা শেয়ালের দলের সঙ্গেই একসঙ্গে মিশে থাকে বলে অম্বরবাবু জানান। এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছে বনদপ্তর। উলুবেড়িয়া বন দফতরের রেঞ্জ অফিসার উৎপল সরকার বিষয়টি নিয়ে বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, হাওড়া জেলায় এই ধরনের ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। এই ঘটনাকে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া মহকুমার প্রায় ৮০ শতাংশই গ্রামাঞ্চল। আর তার বেশিরভাগ এলাকা জুড়ে রয়েছে স্বাভাবিক বনাঞ্চল ও বাদাবন। এইসব গ্রাম্য এলাকায় রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় জলাশয়। বনজঙ্গল ও জলাশয়ে রয়েছে তাদের খাদ্যসম্ভার। যার ফলে বন্যপ্রাণী জন্ম নেওয়া এবং তা স্বাভাবিক নিয়মে বেড়ে ওঠার পক্ষে এইসব এলাকা আদর্শ। কিন্তু সামাজিক সচেতনতার অভাবে বহু বন্যপ্রাণী অচিরেই হারিয়ে যাচ্ছে। জয়পুর ও আমতা এলাকা বন্যপ্রাণীদের খনি বলে অম্বরবাবু দাবি করেন। তিনি বলেন, “এখানে যে শুধু বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী বসবাস করে তাই নয়, এই এলাকায় বেশ কিছু বিরল প্রজাতির পাখিও বসবাস করে। যা সাধারণত দক্ষিণবঙ্গের কোথাও দেখা যায় না।” উলুবেড়িয়ার নতিবপুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বর চক্রবর্তী জানান, একদিন রাতে তিনি আমতার নারিট এলাকায় ফিশিং ক্যাট বা বাঘরোলের ছবি তোলার জন্য একটি ঘন ঝোপের কাছে আত্মগোপন করে ছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তিনি প্রায় ৮-১০টি শিয়ালকে পার্শ্ববর্তী ঘন বাঁশবন থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে কিছুটা হেঁটে পাশের ঝোপে প্রবেশ করতে দেখেন।
এই দৃশ্য তাঁর কাছে নতুন নয়, কিন্তু ওই শিয়ালের দলে দু’টি কুকুর জাতীয় প্রাণীকে দেখে তিনি চমকে ওঠেন। টর্চের আলো ফেলে তিনি তাদের ভাল করে লক্ষ্য করেন। এবং একই সঙ্গে পুরো বিষয়টি তিনি ভিডিও ক্যামেরা বন্দি করেন। যে দু’টি অদ্ভুতদর্শন প্রাণী ওই শিয়ালের দলে ছিল তাদের গায়ের রং কুকুরের মতো কিছুটা সাদা ও কমলায় মেশানো। তাদের চোখ, কান ও লেজ পুরোপুরি শিয়ালের মতো। সাধারণত এই সব এলাকার রাস্তার কুকুরদের লেজ বা পুচ্ছ ঘন লোম বিশিষ্ট হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে এই বর্ণসংকর প্রাণীর লেজ পুরোপুরি শিয়ালের মত ঘন লোম বিশিষ্ট। এছাড়াও তাদের হাঁটাচলা পুরোটাই শেয়ালের মতো। শিয়াল পিছনের পায়ের সামান্য চাপে দুলকি চলে হাঁটে। কিছুটা ঘোড়ার মতো। এক্ষেত্রেও ওই বর্ণসংকর প্রাণী দু’টিকে শেয়ালের মতোই দুলকি চালে হাঁটতে দেখা গিয়েছে।
বিশিষ্ট পরিবেশবিদ অধ্যাপক আক্রামুল হক মনে করেন, আমতা, জয়পুর হল হাওড়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রামীণ সীমান্তবর্তী এলাকা। ওইসব এলাকায় বনজঙ্গল খুবই ঘন সন্নিবিষ্ট। সেই সঙ্গে রয়েছে দামোদর নদ ও তার একাধিক খাল এবং অসংখ্য জলাশয়। এই আদর্শ পরিবেশের ফলে ওই এলাকায় শেয়াল (ইন্ডিয়ান গোল্ডেন জ্যাকল) ছাড়াও আছে অসংখ্য বাঘরোল বা ফিশিং ক্যাট, গন্ধগোকুল, খটাশ ইত্যাদি। ওইসব এলাকায় খাদ্যের সন্ধানে সন্ধ্যার পর লোকালয়ে শিয়াল ঘুরতে দেখা যায়। বহু ক্ষেত্রে রাস্তার কুকুরের সঙ্গে তাদের সখ্য লক্ষ্য করা গিয়েছে। এবং তাদের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে সংকরায়ন ঘটেছে। যার ফলশ্রুতি হল ওই বর্ণসংকর নতুন প্রজাতির প্রাণী। এই ঘটনা হাওড়া জেলায় নতুন হলেও একেবারে অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তবে যেহেতু হাওড়া জেলায় এই ঘটনা এই প্রথম তাই তিনি অম্বরবাবুর আবিষ্কারকে এক ‘যুগান্তকারী আবিষ্কার’ বলে মনে করেন। এই বর্ণসংকর প্রাণী গুলিকে সুরক্ষিত রাখার জন্য যত শীঘ্র সম্ভব এই বিষয়ে বন দফতরের চিন্তাভাবনা করা উচিত বলে মনে করেন অধ্যাপক আক্রামুল হক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.