ফাইল ছবি।
অমিত সিং দেও, সিমনি (মানবাজার): মানুষ-বন্যপ্রাণ সংঘাত ঠেকাতে বনদপ্তরের ঢাল শুধুই ‘প্রচার’। প্রায় দু’ বছর ধরে পুরুলিয়ার (Purulia) কোটশিলার পাহাড়ি জঙ্গলে ঘর-সংসার করার পর এবার লোকালয়ে হানা দেওয়ায় আতঙ্কে কাঁটা সিমনি গ্রামের মানুষজন। বনদপ্তরের প্রতি গ্রামবাসীদের প্রশ্ন, এখন বাড়িতে ঢুকে চিতাবাঘ (Leopard) মানুষজনের উপর হামলা চালালে তারা কী করবেন? এই বিষয়ে পুরুলিয়া বন বিভাগের ডিএফও (DFO) কার্তিকেয়ন এম বলেন, “আমরা সচেতনার প্রচার চালাচ্ছি। রাতের অন্ধকারে গ্রামবাসীদের বাইরে যেতে বারণ করা হয়েছে।” বনদপ্তরের এমন উত্তরে কার্যত অবাক সিমনি পাহাড়তলির মানুষজন।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম কোটশিলার রেঞ্জের সিমনি বিটের পাহাড়ে একটি চিতাবাঘের আনাগোনার খবর পাওয়া যায়। জঙ্গলে মেলে পায়ের ছাপ। পরে জঙ্গলে মৃত গবাদি পশুর পাশে বসানো ট্র্যাপ ক্যামেরায় (Trap Camera) ধরা পড়ে একটি পূর্ণবয়স্ক চিতাবাঘের ছবি। গ্রামবাসীরা জানালেন, সেই সময় থেকে এখনও পর্যন্ত জঙ্গলের ভিতরে লাগাতার ২৭ টিরও বেশি গবাদি পশু চিতাবাঘের হামলার শিকার হয়েছে। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি ঝাড়খণ্ডেরও। বনদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, পুরুষ চিতাবাঘের ছবি ধরা পড়ার পর একাধিকবার ক্যামেরা পাতা হয়েছে। তাতে মাদী এবং শাবকেরও ছবি ধরা পড়ে। অর্থাৎ ভয়মুক্ত পরিবেশে সিমনির (Simni) জঙ্গলে পাকাপাকি ভাবে ঘর-সংসার করে ফেলেছে চিতার পরিবার।
২০১৫ সালে ২০ জুন এই কোটশিলা রেঞ্জের টাটুয়াড়াতে দিনের আলোতে গ্রামে ঢুকে পড়ায় একটি পুরুষ চিতাবাঘকে পিটিয়ে মারার (Lynched to death) অভিযোগ ওঠে ওই গ্রামের মানুষজনের বিরুদ্ধে। শুধু ‘হত্যা’ করা নয়। তার পা, লেজ কেটে একটি নিম গাছে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। আর ওই ঘটনার ফের কোটশিলা বনাঞ্চলে চিতাবাঘ সংসার পাতায় সেই সময় খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়ে বনদপ্তর। কারণ ওই চিতাবাঘটি বন্য শূকর, হরিণের পাশাপশি ধারাবাহিকভাবে জঙ্গলে থাকা গবাদি পশুদের শিকার করে। কিন্তু তার পরেও সিমনি গ্রামের মানুষজন চাইছিলেন, জঙ্গলে সুখে সংসার করুক চিতার পরিবার।
কিন্তু গৃহস্থের ঘরে চিতাবাঘের হানায় কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে গ্রামবাসীদের। পাশাপশি বনদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে গ্রামবাসীদের। ২০২৩ সালে শাবকের জন্মের খবর পাওয়ার পর শুধুমাত্র একটি খাঁচা কোটশিলা বনাঞ্চল কার্যালয়ে পাঠানো যায়। কয়েকদিন আগে ওই খাঁচা পৌঁছয় সিমনি বিটে। বনদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, পুরুলিয়ার সিমনিতেই শুধু মাত্র চিতাবাঘ রয়েছে। অথচ তাকে ঘিরে সেভাবে কোনও হেলদোল দেখা যায়নি দপ্তরের। একদিকে কর্মী সংকট। অন্যদিকে যন্ত্রপাতির কোনো জোগান নেই। ফলে চিতাবাঘের মোকাবিলায় শুধু প্রচারেই ঢাল বনদপ্তরের। বর্তমানে সিমনি বিটে একজন বিট অফিসার, দুজন সিডিএল ও একজন বন সহায়ক রয়েছেন। নেই কোনো গাড়ি, ট্রাঙ্কুলাইজার বন্দুক, জাল।
ফলে সোমবার রাতে ঘটনার কথা বিট অফিসে জানানোর পর একজন কর্মীকে সঙ্গে নিয়েই ঘটনাস্থলে লাঠি হাতে মোটরবাইক নিয়ে পৌঁছন সিমনি বিটের আধিকারিক। ঘটনাস্থলে পৌঁছে গ্রামবাসীদের সঙ্গে লাঠি হাতে পটকা ফাটিয়ে ঘুরে দেখেন গ্রামের চারপাশ। পরে দু’ প্যাকেট ফটকা দেওয়া হয় গ্রামবাসীদের। এমন পরিস্থিতি দেখে গ্রামবাসীদের প্রশ্ন রাতের অন্ধকারে বাড়িতে ঢুকে মানুষের উপর ওই চিতাটি হামলা চালালে টাটুয়াড়ার পুনরাবৃত্তি হবে না তো? যদিও এই প্রশ্নের সেভাবে কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি বনদপ্তরের কোনও কর্তা। ডিএফও বলেন, “গ্রামবাসীদের হাতে টর্চ লাইট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
রবিবার রাতের ঘটনার পর বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছেন বলে দাবি ওই গ্রামের বধূ রাজবালা কর্মকারের। তাঁর কথায়, “এর পর যদি চিতাবাঘ আমাদের উপর হামলা চালায়, কী করব আমরা? নিজের প্রাণ বাঁচাতে আমরা কি প্রতিরোধ করব না? বনদপ্তরের কাছ থেকে তো কোনও উত্তরই পাচ্ছি না।” রবিবার রাতের পর উঠোনের পাশে পর পর চারটি পায়ের ছাপ যত্ন করে ঢেকে রেখেছিলেন ওই পরিবার। তারা ভেবেছিলেন, এই ঘটনার পর যদি সরেজমিনে তদন্তে যান বনদপ্তরের জেলা আধিকারিকরা। কিন্তু এদিন রাত পর্যন্ত বিট অফিসার ছাড়া তাদের কাছ থেকে ঘটনার বিবরণ জানতে পৌঁছননি বনদপ্তরের কোনও আধিকারিক।
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.