সুমন করাতি, হুগলি: এক সময়ের উর্বর জমিতে এখন শুধুই কংক্রিটের গুঁড়ো। বহু জমি এখনও চাষযোগ্য হয়নি। অথচ দেড় দশক ধরে লড়তে হচ্ছে আইনি লড়াই। এসব শেষে আবার ট্রাইব্যুনালের (Arbitral tribunal) রায়ে রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে মোটা অঙ্কের জরিমানা বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এসব যেন মেনে নিতে পারছে না সিঙ্গুর। সিঙ্গুরবাসীর একটা অংশ ক্ষোভে ফুঁসছেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা ভাবছেন। আরেকটা অংশের আবার আক্ষেপ, ‘এর চেয়ে বোধ হয় শিল্প হলেই ভালো হত।’
রাজ্যে পালাবদলের অন্যতম অনুঘটক ছিল সিঙ্গুর আন্দোলন। সিঙ্গুরের মানুষ সেসময় রায় দেয় তৃণমূলের পক্ষে। তার পর কেটেছে প্রায় দেড় দশক। সোমবার আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনাল নির্দেশ দিয়েছে, টাটা মোটরসকে ৭৬৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে রাজ্য সরকার। আর এই রায় শোনার পর থেকেই সিঙ্গুরের কৃষকরা ক্ষোভে ফুঁসতে শুরু করেছেন। মঙ্গলবার সিঙ্গুরের জমি আন্দলনকারী মহিলারা চাষের জমিতে নেমে রায়ের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছেন। তাঁদের দাবি, সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন ছিল কৃষিজমি রক্ষার দাবিতে। জোর করে রাতের অন্ধকারে চাষীদের মেরে জমি ঘিরে নিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ। অন্যায়ভাবে জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে শুরু হয়েছিল আন্দোলন। এই ক্ষতিপূরণের রায় তাঁরা মানছেন না।
সিঙ্গুরের কৃষক অমিয় ধাড়া বলেন, তারা এই ক্ষতিপূরণের রায় মানছেন না। আবার তাদের আন্দোলন শুরু হবে এই রায়ের বিরুদ্ধে। কারণ সেই সময় তৎকালীন বাম সরকার কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই তাদের উর্বর জমি দখল করেছিল। চাষিদের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি জমি অধিগ্রহণের সময়। এর পর যখন তারা জানতে পারেন ৪০০ একর উর্বর জমি বাদ দিয়ে শিল্প হবে, তখন তারা রাজি হন। কিন্তু কেন তখন টাটা চলে গেলো সেটা কেউ জানে না। এখন যে সমস্ত উর্বর জমি কারখানার জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, সেই জায়গায় নতুন করে চাষ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষতিপূরণের যে রায় ট্রাইব্যুনাল দিয়েছে সেটা ঠিক হয়নি।
২০০৬ সালে সিঙ্গুরের বেড়াবেড়ি, গোপালনগর, কেজিডি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫টি মৌজায় অধিগ্রহণের প্রতিবাদে অনিচ্ছুক কৃষকদের আন্দোলন প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। এর পর ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিঙ্গুরে টাটার অধিগৃহীত জমি কৃষকদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ঠিক তার পরের বছর ২০১৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুরে এসে প্রকল্প এলাকায় সরষে বীজ বপণ করেন। এর পর জমি চাষের উপযুক্ত করে তুলতে প্রকল্প এলাকাকে ১০০ দিনের কাজের আওতায় এনে জমির জঙ্গল পরিষ্কার করার কাজ হয়। সেখানে ৫৬টি মিনি ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এখন ৮৫ শতাংশ জমিতে চাষ হচ্ছে। বাকি জমি আগাছায় ভর্তি। সেটাও কারখানার তৈরির সরঞ্জাম থাকার কারণে।
যেসব জমি এখনও চাষযোগ্য হয়নি, সেসব কৃষকরা যেন এখন সর্বহারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষক পরিবার বলছে, শিল্প হলে ভালোই হতো। অনেক মানুষ কাজ পেত। তাদের এলাকার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে, তারা কি পড়াশোনা শেষে চাষ করবে? তারা তো চাইবে চাকরি করতে। তাই শিল্প হলে অনেক ভালো হতো। আরেক চাষি বলছেন, তারা হয়তো জমি ফেরত পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু জমি তো আর আগের অবস্থায় নেই, সেভাবে আর চাষ করাও যায় না। তাই যখন শিল্প হচ্ছিল হলেই ভালো হতো তাহলে অন্তত এলাকার বহু ছেলে মেয়ে চাকরি পেয়ে কর্মসংস্থান হতো। বস্তুত ক্ষতিপূরণের রায়ের পরে একটা দ্বিধাবিভক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সিঙ্গুরে। কৃষকদের একাংশ নতুন করে আন্দোলনের হুশিয়ারি দিয়ে অতীতের সিঙ্গুর আন্দোলনের ছবি মনে করাচ্ছে। আরেকটা অংশ যেন নীরবে এই ক্ষতিপূরণের নির্দেশকেই সমর্থন করছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.