সৌরভ মাজি, বর্ধমান: বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই ঘটনা। শনিবার সন্ধের পর থেকে টেলিভিশনের পর্দায় একটাই ছবি ভেসে উঠছিল – হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ছে বর্ধমান জংশন স্টেশনের একটি অংশ। ছবি যত জুম ইন হয়েছে, তত ভালভাবে বোঝা গিয়েছে জায়গাটি। ১ নং প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে বারান্দা, পোর্টিকো এবং অনুসন্ধান কেন্দ্রের দিক দিয়ে বেরনোর রাস্তাতেই কয়েকটি থাম ভেঙে পড়ে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ‘বর্দ্ধমান জংশন’ নামাঙ্কিত বোর্ডটিও। ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়, একজন আহত। রেলের সংস্কারের কাজ চলাকালীন এমন একটা দুর্ঘটনায় ঘিরে নানা মহলে নানা কথা উঠছে।
তবে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নেওয়ার পর ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন বর্ধমানবাসী। তাঁদের মন খারাপের কারণ একটাই – হেরিটেজ স্টেশনের স্মৃতি। রাজারাজড়ার আমলের এই বর্ধমান স্টেশনের বয়স পেরিয়ে গিয়েছে সার্ধ শতকেরও বেশি। শনিবারের এই থাম, ছাদ ভেঙে পড়া নিছকই দুর্ঘটনা তো নয়, সেইসঙ্গে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটা ইতিহাসও। হাজার সৌন্দর্যায়ন, শক্তপোক্ত ভিতের উপর নতুন রূপে স্টেশন তৈরি হলেও, যা ফিরবে না। একথা বুঝে কিছুটা বিষণ্ণ ইতিহাসপ্রেমী মহল। আপাতত তাঁরা স্মৃতিচারণায় মশগুল।
ভারত তখন ব্রিটিশ অধীনস্ত। ততদিনে সাহেবরা বুঝে গিয়েছেন, গোটা দেশজুড়ে ব্যবসা বাড়াতে হলে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। তাই রেলপথে দেশকে জুড়তে মহাযজ্ঞ শুরু হয়ে গিয়েছে। ইতিহাস বলে, ১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট বর্ধমান-হাওড়া লাইনে ট্র্যাকের উপর দিয়ে রেলইঞ্জিনের চাকা কু-ঝিকঝিক শব্দ তুললেও, পরের বছর অর্থাৎ ১৮৫৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখানে রেল চলাচল শুরু হয়। সেদিন হাওড়ায় ট্রেনের উদ্বোধন করেন তৎকালীন গভর্নর লর্ড ডালহৌসি। আর ট্রেনটিকে বর্ধমানে স্বাগত জানাতে পুরোদস্তুর উৎসবে মেজাজে বর্ধমানের তৎকালীন রাজা মহতাব চাঁদ হাতির পিঠে চড়ে, বহুমূল্য পোশাকে সজ্জিত হয়ে স্টেশনে পৌঁছন। এমন শুভদিনে তিনি সমবেত জনতাকে পানভোজনে তৃপ্তি করেন। সেসব ছবি রয়েছে রেলের ফটো গ্যালারিতেও।বর্ধমান ইতিহাস ও পুরাতত্ব চর্চা কেন্দ্রের সম্পাদক সর্বজিৎ যশের লেখাতেও সেই ইতিহাসের উল্লেখ রয়েছে।
একটা দুর্ঘটনা এক লহমায় মুছে দিয়েছে ইতিহাসের এতটা অংশ। তবে কেউ কেউ স্বান্তনা খুঁজে পাচ্ছেন অন্য একটি বিষয় ভেবে। দিল্লি থেকে হাওড়া পণ্য করিডোর তৈরির জন্য বর্ধমান মূল স্টেশনের এই অংশটি ভাঙা পড়তই। ওই রেলপথটি ইতিমধ্যেই শক্তিগড়ের আগে পাল্লা রোড পর্যন্ত তৈরি হয়ে গিয়েছে। এবার বর্ধমান জংশনের এই অংশটি দিয়ে বাকিটা তৈরির পরিকল্পনা। ফলে ইতিহাস মুছতই। তবু কিছুটা যত্ন করে তাকে রাখাই যেত। ব্রিটিশ আমলে লোহার বিম, ইট-চুন-সুড়কিগুলো আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যাচ্ছিল। সেখানে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করে তবেই সংস্কারের কাজ করা দরকার। কিন্তু বর্ধমানে তা হয়নি। স্থানীয়রা বলছেন, বাইরে থেকেই সৌন্দর্যায়নের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। টাইলস লাগানো, রং করা ইত্যাদির কাজ চলেছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। অষ্টাদশ শতকের পাঁচের দশক থেকে একুশ শতকের তৃতীয় দশক – এই সময়টুকুকে সঙ্গে নিয়ে হারিয়ে গেল বর্ধমান স্টেশনের ইতিহাস।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.