পারমিতা পাল: এক্সিট পোল আর একজ্যাক্ট পোলের মধ্যে বিস্তর তফাত ঘটিয়ে দিতে পারেন কে? বাংলার মাটি জানে, তিনি এক এবং অদ্বিতীয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়(Mamata Banerjee)। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের পালাবদলে তিনি স্বয়ং একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়। ১৯৭৭ সালের পর দেশের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনেও ইতিহাসের নতুন ভাষ্যই রচনা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুথফেরত সমীক্ষার সমস্ত সম্ভাবনাকে কার্যত উড়িয়ে দিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক বাস্তবতা জানিয়ে দিল, মমতা বাংলার এবং বাংলা মমতারই।
অদম্য জেদ, কৌশলী রাজনৈতিক বুদ্ধি এবং নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম। দেশের রাজনীতি এই সবকিছুর সমার্থক হিসাবে মমতাকেই জানে। একুশের বিধানসভায় বিজেপি যখন সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়েছিল, তখনও তিনি আগলে রেখেছিলেন বাংলাকে। সেই বিপুল জয়ের পরেও বিন্দুমাত্র আত্মতুষ্টিতে ভোগেননি মমতা। নেমে পড়েছিলেন পরের লড়াই লড়তে। বারবার দুর্ঘটনার মুখে পড়েছেন, অসুস্থ হয়েছেন, ঝড়-জল মাথায় নিয়ে গত আড়াই মাস লাগাতার প্রচার সেরেছেন মা-মাটি-মানুষের নেত্রী। আর সে লড়াইয়ে দোসর ছিলেন দলের যোগ্য সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়(Abhishek Banerjee)। চব্বিশের লোকসভায় বাংলার চমকপ্রদ ফলাফল জানাল, মমতার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আর অভিষেকের পরিশ্রমী সাংগঠনিক শক্তির যুগিলবন্দির কাছে ডাহা ফেল বিজেপির প্রবল পরাক্রমশালী ভোট মেশিনারি।
অথচ বুথফেরত সমীক্ষা যেন খানিক অন্য কথাই বলছিল। সেই নিয়ে গত ক-দিনে চর্চা কম হয়নি। তবে সেই সব ঝোড়ো হাওয়ায় আত্মবিশ্বাসে টাল ধরেনি তৃণমূলের। ‘প্রথম ৬ দফায় আমরা ২৩ আসন পেয়ে গেছি। ২০১৪-এর চেয়ে বেশি আসন পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’ – ভোট-সপ্তমীর আগে এমনই দাবি করেছিলেন তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বহু ভোট বিশেষজ্ঞরা তাঁর দাবি হেসে উড়িয়েছিলেন। এক্সিট পোলও দাবি করেছিল, বাংলায় তৃণমূল নাকি ১৩-১৮-র বেশি আসন পাবে না। পালটা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘এক্সিট পোল ফেক। মানি না।’ তখনও বোঝা যায়নি রেমালের পর বাংলায় আসতে চলেছে সবুজ-সাইক্লোন। প্রতিবেদনটি যখন লেখা হচ্ছে, তখনও অবধি রাজ্যের ৩১ আসনে এগিয়ে ঘাসফুল শিবির। যা থেকে স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে, বাংলায় মোদি গ্যারান্টি কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। বরং বাংলা নিজের মেয়েকেই চেয়েছে।
একের পর এক জনকল্যাণমূলক প্রকল্প। সুশাসন। কৌশলি-স্ট্র্যাটেজি। এগুলো নিশ্চিতই তৃণমূলের জয়ের অন্যতম কারণ। তবে সবথেকে বড় কারণ মমতা এবং অভিষেকের ৫ মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম। বাংলার রাজনীতির মানচিত্র তাঁরা হাতের তালুর মতোই চেনেন। আরও ভালো চেনেন বাঙালির মন। তাঁর পরেও অবশ্য কিছু অভাব-অভিযোগ জমে। রাজনীতিতে তা অস্বাভাবিক নয়। খেয়াল করার মতো বিষয় যে, তা তাঁরা উড়িয়ে দেননি।বরং শুনেছিলেন মন দিয়ে। সমাধান করার চেষ্টা করেছিলেন আরও গুরুত্ব দিয়ে।
জনতার দাবি মেনেই দলের সংগঠন চাঙ্গা করতে নেমেছিলেন অভিষেক। ২০২৩ সালে নবজোয়ার কর্মসূচি নিয়ে চষে ফেলেছিলেন গোটা রাজ্য। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, সেরেছিলেন টানা জনসংযোগ। কার কী অভিযোগ রয়েছে শুনেছিলেন মন দিয়ে। কোথায় প্রশাসনিক খামতি রয়েছে, কোথায় সংগঠন দুর্বল, কোথায়-কোথায় দলের অন্দরে চোরাস্রোত বইছে নিজের ডায়েরিতে নোট করে নিয়েছিলেন সবটা। আর অসুখ একবার চিহ্নিত হয়ে গেলে চিকিৎসা তো সহজ। সেটাই করেছিলেন ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে বসে। অবশ্যই দলনেত্রীর থেকে সবুজ সংকেত নিয়ে। আর তারই সুফল মিলল চব্বিশের লোকসভা ভোটে। কী কী করেছেন মমতা-অভিষেক?
শুরুটা হয়েছিল উত্তর থেকে। চা বাগানের শ্রমিকদের পাট্টা বিলি, সেখানকার শ্রমিকদের সন্তানের জন্য ক্রেস তৈরি, ধূপগুড়িকে মহকুমা ঘোষণার মতো একাধিক প্রশাসনিক পদক্ষেপ করেছ রাজ্য সরকার। তেমনই আবার চা বাগানগুলিতে তৃণমূলের সংগঠন শক্ত করেছেন অভিষেক। চা শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা পাইয়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলন করেছে তৃণমূল নেতৃত্ব। আর তারই সুফল মিলেছে ভোটবাক্সে। শুধু উত্তর কেন, জঙ্গলমহল, রাঢ়বঙ্গ, উপকূল অঞ্চলের- সমস্যা আলাদা আলাদা করে চিহ্নিত করে, তাদের সমাধান করেছে মমতা-অভিষেক। প্রতি লোকসভা কেন্দ্রে তার সুফল পেয়েছে ঘাসফুল শিবির।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, প্রথম দফা ভোটের আগে ক্ষণিকের ঘূর্ণিঝড়়ে লন্ডভন্ড হয়েছিল আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিংয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা। সেদিন ভোট রাজনীতির কথা ভুলে রাতারাতি মমতা অবতীর্ণ হয়েছিলেন ‘মাতৃ’রূপে। অভিভাবকরূপে দাঁড়িয়ে থেকে মানুষের হয়ে কাজ করেছিলেন তিনি। ‘রেমালে’র পর একইরূপে দেখা গিয়েছিল অভিষেককেও।
একদিকে অভিভাবক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব, জনপ্রিয়তা, প্রশাসনিক দক্ষতা আর অভিভাবকত্ব, অন্যদিকে সেনাপতি অভিষেকের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা মানসিকতা, কড়া হাতে সংগঠন সামলানোর দক্ষতা আর দলনেত্রীর থেকে প্রাপ্ত অদম্য জেদ। দুয়ের যোগফলেই বাংলার ৩১ কেন্দ্রে ফুটল জোড়াফুল। বিজেপি চেষ্টার খামতি করেননি। মোদি-শাহ-নাড্ডা এবারেও প্রায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছেন। তবে তিথির অতিথিকে চায় না বাংলা। ভোটের ফলাফল প্রায় সোচ্চারেই জানিয়ে দিল, বাংলা এখনও তাঁর নিজের মেয়েকেই চায়। অতএব, ‘রঙ দে তু মোহে গেরুয়া’ বক্তব্যে ঘোর অরুচি জানিয়ে বাংলা থাকল অকৃত্রিম সবুজায়নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.