গোবিন্দ রায়: হিঙ্গলগঞ্জের দুলদুলি পাড়ে তখন সন্ধেয় চায়ের দোকান জমজমাট। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কেউ ব্যস্ত রাজনৈতিক তরজায়, কেউ ব্যস্ত পেট্রল-ডিজেলের দাম নিয়ে দর কষাকষিতে, আবার কেউ টেলিভিশনের পর্দায় মুখ গুঁজেছেন। হঠাৎ হই-হই রব পড়ে যায় এলাকায়। একটি বাচ্চা ১০ টাকার চা-বিস্কুট খেয়েছে, কিন্তু দিচ্ছে ৫০০ টাকা। এই বাজারে ১০ টাকার খেয়ে ৫০০ টাকা কে দেয়! চায়ের দোকানি ধমক দিতেই পকেট থেকে আরও ৫০০ টাকা বের করে দেয় বাচ্চাটি। চারিদিকে তখন হই-হট্টগোল পড়ে গিয়েছে। উপস্থিত সকলে এসে এসে বাচ্চাটিকে ঘিরে ধরে জিজ্ঞেস করছে, “তোর নাম কী? থাকিস কোথায় ?” কিন্তু বাচ্চাটির নীরব দর্শক।
কী করবে, কিছুই শুনতে পায় না, বলতেও পারে না। কে কী বলছে বুঝবেই বা কী করে? এদিকে তার এই অবস্থার কথা তো স্থানীয় বাসিন্দারা জানেন না। তারা সবাই বাচ্চাটির পরিচয় জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। চেপে ধরতেই কেঁদে ফেলে বাচ্চাটি। শুধু হাতে কী সব লেখা রয়েছে, তাও বুঝতে পারছেন না হিঙ্গলগঞ্জ বাসিন্দারা। পরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় হিঙ্গলগঞ্জ থানায়। পোশাকের পকেট দেখে পুলিশের তো চক্ষু চড়কগাছ। বাচ্চাটির পকেটে নগদ ২১ হাজার টাকা! এইটুকু বাচ্চার পকেটে এত টাকা এল কী করে? কোথা থেকেই বা সে এখানে এসেছে? বাচ্চাটির হাতে লেখা দেখে পুলিশ জানতে পারে, হিন্দিতে লেখা রয়েছে নীরজ। এক মূক-বধির বাচ্চার ঠিকানা খুঁজতে শুধু হাতে হিন্দিতে লেখা নাম নিরাজই তো যথেষ্ট নয়। সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে খোঁজখবর লাগায় পুলিশ। বাচ্চাটির ছবিও চলে যায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিশু সুরক্ষা সংস্থার হাতে। ততক্ষনে খবর পৌঁছেছে হ্যাম রেডিওর কাছেও।
হ্যাম রেডিও আসলে ওয়াকিটকির মতো এক বিশেষ ওয়্যারলেস ব্যবস্থা। যার মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে যোগাযোগের জন্য বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যায় সারা দেশে। শুধুমাত্র এ দেশেই নয়, দেশের বাইরে সার্কের আওতায় থাকা প্রত্যেকটি দেশেই হ্যাম রেডিও কার্যকর। অবশেষে সেই রেডিও-র মাধ্যমে সাহায্যে পাটনার এক চিকিৎসক পবনকুমার সিং বাচ্চাটিকে চিনতে পারে। সে খবর পাঠায় তার বাবা-মাকে। খবর পেয়ে বাবা-মাও যোগাযোগ করেন হ্যামরেডিওর সম্পাদক অম্বরীশ নাগ বিশ্বাসের সঙ্গে।
জানা যায়, বিহারের পাটনার পাথরহাট এলাকার বাসিন্দা নীরজ। বাবা চাষবাস করেন। সঙ্গে টিউবয়েলের ঠিকাদার। বাড়ি থেকে ধান বিক্রির টাকা নিয়ে কাউকে না জানিয়েই একমাস আগে বেরিয়ে পড়ে বছর বারোর নীরজ কুমার। আত্মীয়-স্বজনেরা বহু দিন খোঁজাখুঁজি করে এক প্রকার হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় এদিন ভিডিও কলে শনাক্ত করা যায় নীরজ তাঁদেরই হারিয়ে যাওয়া সন্তান। অবশেষে হাতে লেখা নামই নীরজকে মিলিয়ে দিল পরিবারের সঙ্গে। নীরজকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে রওনা দিয়েছে তার পরিবার। বুধবার পুনরায় শনাক্তকরণের পর স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে নিরাজকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তার পরিবারের। কিন্তু আইনি জটিলতায় তা সম্ভব হয়নি। এদিন তারা সমস্ত তথ্য ও পরিচয়পত্র নিয়ে এলেও আইনি জটিলতায় নীরজের বাড়ি ফেরা হল না। চোখের জলে খালি হাতে ফিরলেন নীরজের পরিবারের সদস্যরা।
মূক ও বধির শিশুকে পরিবারের সঙ্গে মেলাতে পেরে খুশি হ্যাম রেডিও সম্পাদক হ্যাম রেডিও ক্লাবের সম্পাদক অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস। তিনি জানান, “করোনা অতিমারী পরিস্থিতির মধ্যে একটা মূক ও বধির বাচ্চা যে বাড়ি ফিরে পেয়েছে তাতে আমরা হ্যাম রেডিও সদস্যরা খুবই খুশি এবং স্থানীয় প্রশাসন ও মানুষদের অসংখ্য ধন্যবাদ।” যারা নীরজকে উদ্ধার করে হ্যাম রেডিওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। স্থানীয় সমাজসেবী সুশান্ত ঘোষ জানান, “বাচ্চাটিকে ঘরে ফিরে পেয়েছে এটা অনেক। এর আগেও আমরা ভিন রাজ্য থেকে আসা বহু মানুষকে এখান থেকে তার ঘরে ফিরিয়েছি।” তবে শিশু সুরক্ষা ও অধিকার আইন বলে, নীরজকে বাড়ি ফিরতে হবে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি (সিডব্লিউসি) র হাত ধরে। ১৮ বছরের নিচে শিশুদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করতেই এই আইন। ফলে বাড়ি ফিরতে নীরজের বেশকিছুটা সময় লাগবে
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.