সুনীপা চক্রবর্তী: একসময় জঙ্গলমহলে ‘মাওবাদীদের রাজধানী’ বলে পরিচিত ছিল বিড়িহাড়ি৷ রাজ্যের একমাত্র মাওবাদীদের বিশাল শহিদ মিনারটিও এখানেই৷ খুন, সন্ত্রাসের রক্তগঙ্গা বইত৷ সন্ত্রাস পরবর্তী পর্বেও মাটি খুঁড়তে মিলেছে অসংখ্য লাশ, কঙ্কাল আর মাইন, আগ্নেয়াস্ত্র৷ গ্রামের নাম বিড়িহাড়ি৷ আর সেই বিড়িহাড়ি গ্রামেই এবার ভূগর্ভস্থ দেবী দুর্গা পাতাল থেকে আহ্বান দিচ্ছেন শান্তির বার্তার৷ মাটি খুঁড়লে আর লাশ নয়, নয় গোলা-বারুদ৷ প্রকৃতির ভূমিজ সম্পদ উঠে আসুক৷ গ্রামের মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি হচ্ছে দেবী দুর্গার অতলের আহ্বান৷ ১২ ফুট নিচে ছেলেমেয়ে নিয়ে পাঁচদিনের জন্য ঘাঁটি গাড়তে চলেছেন দেবী দুর্গা৷ আর দেড়শো ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ ধরে দর্শককুল পৌঁছে যাবেন শান্তিরূপী মায়ের কাছে৷ বিড়িহাড়ি-সহ আশপাশের ১৫-২০টি গ্রামের মানুষ যাঁরা এর আগে তেমনভাবে শারদীয় পুজোয় মেতে উঠতে পারতেন না, তাঁদের আনন্দ-উৎসবে শামিল করতে এমনই অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন গ্রামের উদ্যোগী যুবকেরা৷
দেবী দুর্গাকে ভূগর্ভস্থ রাখার ভাবনাটি এল কীভাবে? বিড়িহাড়ি ‘উদীয়মান’ ক্লাবের সম্পাদক এবং পুজো কমিটির সভাপতি জগদীশ মাহাতো, চিত্রেশ্বর মাহাতোরা বলেন, একসময় আমাদের এলাকা মাওবাদীদের সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ ছিল৷ দু’পক্ষের চাপে (মাও আর পুলিশ) গ্রামবাসীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত ছিল৷ মাটি খুঁড়লেই লাশ আর কঙ্কাল৷ আমাদের ভাবনার শুরু ওখান থেকেই৷ দেবী দুর্গা পাতাল থেকে শান্তির বার্তা দেবেন৷ মাটির তলা পবিত্র৷ গাছ থেকে শুরু করে নানা প্রাণের সঞ্চার ঘটে৷ দেবী শান্তি, মূল্যবোধ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দেবেন৷” এতদিন পর্যন্ত গ্রামের মানুষজনকে ১২-১৩ কিমি দূরে গিয়ে পুজো দেখতে হত৷ অনেকে দূরের কারণে যেতেন না৷ কিন্তু প্রথম বর্ষের গ্রামের পুজোয় বাসিন্দারা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে লেগে পড়েছেন গ্রামে দেবী মাকে আনতে৷ একেই হয়তো বলে ‘আয়রনি অফ ফেট’ বা ‘অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাস’৷ তা না হলে যে মাওবাদীরা একসময় বন্দুক উঁচিয়ে, খুন করে এলাকা দাপিয়ে ছিল, আজ সেই সব মাওবাদীদের বিশাল শহিদ মিনারের সামনেই গ্রামবাসীরা মুক্তমনে দেবীর আরাধনা করছেন৷ একসময় মাওবাদীদের চাপে কোমরে, মাথায় গামছা বেঁধে মিটিং-মিছিলে যেতেন গ্রামবাসীরা৷ আজ তাঁরাই গামছা বেঁধে কোদাল, গাঁইতি নিয়ে খুবই ব্যস্ত পুজোর কাজে৷ উত্তম মাহাতো, খোকন মাহাতো, জয়ন্ত মাহাতো, সুনীল মাহাতো, সুব্রত দাসরা কাজের ফাঁকে একটু বিশ্রাম নিতে নিতে বলেন, “আমাদের গ্রামের প্রথম বড় পুজো৷ আমাদের দম ফেলার সময় নেই৷ পুরাতন সন্ত্রাস, খুনের কথা মনে রাখতে চাই না৷ পুজোর পাঁচটা দিন পরিবারের সবাইকে শুধু আনন্দ দিতে চাই৷” প্রথম পুজো উপলক্ষে পুজোর পাঁচদিন ধরে থাকছে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান৷ ঝুমুর, বাউল-সহ ছোটদের নানা অনুষ্ঠান৷ বিড়িহাড়ি ফুটবল মাঠ ঘিরে এখন থেকেই মেতে উঠেছেন গ্রামবাসীরা৷ একদিকে চলছে মাটি কাটার কাজ৷ আর অন্যদিকে গ্রামের মানুষেরা কেউ বুনছেন শালপাতা, কেউ বুনছেন জাল৷ গ্রামের গীতারানি মাহাতো, মঞ্জু মাহাতোরা আবার হাট থেকে বাড়ি ফেরার পথে পুজোর মাঠের উপর দিয়ে ফিরছিলেন৷ তারা বলেন, খুব মজা হচ্ছে৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.