সুরজিৎ দেব: আমফানের তান্ডবের পর কেটে গিয়েছে পাঁচ-পাঁচটা দিন। এখনও বিদ্যুৎহীন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার এক বিস্তীর্ণ অংশ জুড়েই। বড়-বড় গাছ পড়ে বহু এলাকায় ছিঁড়ে পড়ে রয়েছে হাইটেনশন তার। উপড়ে পড়েছে হাজার-হাজার বিদ্যুতের খুঁটি। বিকল ট্রান্সফরমারও। জরুরি ভিত্তিতে পরিষেবা স্বাভাবিক করার চেষ্টার অন্ত নেই। তা সত্ত্বেও কবে যে আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে জানা নেই বিদ্যুৎ দপ্তরের কর্তাদেরও। অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে নাজেহাল মানুষ সম্মিলিত উদ্যোগে পাড়ায় পাড়ায় বসিয়েছেন জেনারেটর। ঘন্টার পর ঘন্টা তার বিকট আওয়াজ অসহ্য মনে হলেও অন্ধকার সরাতে এটুকু মেনে নিচ্ছেন সকলেই।
সত্যিই তাই। ঘন্টার পর ঘন্টা জেনারেটরের বিকট আওয়াজ মেনে নিতেই হচ্ছে। মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও কিছুই করার নেই। রাতের অন্ধকার দূর করতে, অসহ্য গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে এটুকু সহ্য না করলেই যে নয়। তার উপর দিন কয়েক ধরেই ইনভার্টার, ইমার্জেন্সি আলো, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, পাওয়ার ব্যাংক এসবও যে বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। জেনারেটর চললেই বাড়িতে বাড়িতে চলছে সেসব চার্জ করার এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা। এমন দিনও যে কখনও আসতে পারে স্বপ্নেও বোধহয় ভাবেননি কেউ। তাই শব্দদূষণের অতীত প্রতিবাদ ভুলে জেনারেটরই এখন ভরসা জেলার শহর ও মফস্বলবাসীর।
সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন জেনারেটর ব্যবসায়ীরাও। স্বাভাবিক ভাড়ার তিনগুণ বেশি ভাড়ায় তাঁদের ব্যবসা চলছে রমরমিয়ে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দশ কিলোওয়াটের একটা জেনারেটরের স্বাভাবিক ভাড়া দিনপ্রতি যেখানে ৫০০ টাকার মধ্যে আর কুড়ি কিলোওয়াটের জেনারেটরের স্বাভাবিক ভাড়া দিনপ্রতি ১২০০ টাকা। এখন ডিজেল ছাড়া সেই ড্রাই জেনারেটরের ভাড়া যথাক্রমে ১৫০০ টাকা ও ৩৫০০ টাকা। শহর ও মফস্বলের পাড়ায় পাড়ায় কোথাও দশ-বারোটি পরিবার মিলে, কোথাও আবার ২০-২২ টি পরিবার একসঙ্গে তাঁদের কাছ থেকে জেনারেটর ভাড়া করছেন বলে জানিয়েছেন ওই ব্যবসায়ীরা। জেনারেটর ব্যবসায়ীরা জানান, ‘এই ভাড়া তো আমাদের নির্ধারিত ভাড়া, এমন অনেকেই আসছেন যাঁরা ডিজেল ছাড়া ড্রাই জেনারেটরের জন্য দিনপ্রতি সাড়ে পাঁচহাজার টাকা পর্যন্তও ভাড়া গুণতে রাজী। কিন্তু আমাদের কাছে যা জেনারেটর ছিল সব ইতিমধ্যেই ভাড়া হয়ে গিয়েছে। তাই অনেককেই ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি আমরা।’
ডায়মন্ডহারবারের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, পাড়ায় কোথাও দশটি বাড়ি, কোথাও কুড়ি-পঁচিশটি বাড়ি মিলে তাঁরা ভাড়া নিয়েছেন এই জেনারেটর। ডিজেল খরচ ও জেনারেটর মেকানিকের খাওয়া খরচ সমেত দিনপ্রতি পরিবারপিছু ১৫০ টাকার বিনিময়ে কেউ নিয়েছেন আলো ও পাখা মিলিয়ে দু’টি পয়েন্ট, কেউ ৩৫০ টাকায় ইনভার্টার মেশিন, জল তোলার পাম্প সহ গোটা বাড়ি আলো জ্বালাতে, পাখা চালাচ্ছেন। বাসিন্দাদের কথায়, লকডাউনের বাজারে কোনও আয় না থাকলেও সংসার খরচের জন্য জমিয়ে রাখা টাকা থেকে বাধ্য হয়েই মেটাতে হচ্ছে এই বাড়তি খরচ।
যাঁদের সামর্থ নেই, তাঁদের অনেকেই খুঁজে বের করতে পেরেছেন পুরোনো দিনের সেই হ্যারিকেন, লণ্ঠন। এতদিন অযত্নে পড়ে থাকা সেই হ্যারিকেন বা লন্ঠন একটু আধটু সরিয়ে, ঝেড়েমুছে জ্বালাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু তাতেও যে তাঁদের বাড়তি খরচ এড়ানো সম্ভব হচ্ছে তা নয়। লিটার প্রতি ত্রিশ টাকা দামের কেরোসিন তেল কালোবাজারিদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে লিটার প্রতি ৭০-৮০ টাকা দরে। যাঁদের ঘরে সেসব পুরোনো স্মৃতিচিহ্ন আর অবশিষ্ট নেই তাঁদের প্যাচপ্যাচে গরম আর ঘন অন্ধকারেই বিনিদ্র কাটাতে হচ্ছে একটার পর একটা রাত। দিনের আলো ফোটার অপেক্ষাতেই থাকতে হচ্ছে তাঁদের।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.