ব্রতদীপ ভট্টাচার্য: সবরমতী আর গঙ্গার জল মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল মহাত্মার কর্মোদ্যোগের ছোঁয়ায়। গুজরাতের সবরমতী নদীর ধারে গান্ধীজির সেই বিশ্বপ্রসিদ্ধ আশ্রমের মতো বাংলার গঙ্গাপাড়ের সোদপুরেও যে তাঁর আর একটি আশ্রম গড়ে উঠেছিল, সে খবর এখন কতজন রাখে? অথচ স্বয়ং গান্ধীজি যাকে নিজের দ্বিতীয় আবাস হিসাবে পরিচয় দিতেন, উত্তর ২৪ পরগনার সেই প্রতিষ্ঠান এখন বিস্মৃতি আর অবহেলায় শেষের দিন গুনছে। খাদি শিল্পের সুবাদে একদা মাথা উঁচু করে চলা আশ্রমটি রক্ষণাবেক্ষণের কোনও উদে্যাগ কেন্দ্রীয় সরকার নেয়নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেরিটেজ বোর্ড তাকে ‘ঐতিহ্যবাহী’ তকমা দিলেও ইউনেস্কো হেরিটেজ তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানটির কপালে বঞ্চনা ছাড়া কিছু জোটেনি। সবরমতির কাছে পদে পদে হেরে গিয়েছে সোদপুর। প্রদর্শশালা, পর্যটনকেন্দ্র, কিছুই হয়নি।
সব মিলিয়ে বাংলার মাটিতে জাতির জনকের স্মৃতি-সম্পদ এই মুহূর্তে খণ্ডহরে পরিণত হয়েছে। প্রায় একশো বছর আগে সোদপুর স্টেশনের কাছে এই আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশিষ্ট গান্ধীবাদী সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ছাত্র এবং বেঙ্গল কেমিক্যালের তৎকালীন সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন তিনি। আশ্রমটির নাম দিয়েছিলেন ‘খাদি প্রতিষ্ঠান’। ১৯২৭ সালের ২ জানুয়ারি গান্ধীজি এই খাদি প্রতিষ্ঠান কলাশালার উদ্বোধন করেন। সে সময় এই খাদি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২০০ জন আবাসিক ছিলেন। গান্ধীজির স্বরাজের ভাবনা তাঁদের চলার পথ দেখাত। মৌমাছি পালন, ঘি উৎপাদন, চর্মশালা, কাপড় তৈরির মতো কাজ হত এই আশ্রমে। প্রতিপত্তি এতই ছিল যে, ১৯২৭ সালে এক লক্ষ টাকার সামগ্রী উৎপাদন হত এই আশ্রম থেকে। ইতিহাস বলছে, ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত নিয়মিত এই আশ্রমে আসতেন গান্ধীজি। স্বাধীনতার দু’দিন আগেও এই আশ্রমেই ছিলেন ‘বাপু’।
[ বিনয় তামাংকে খুনের হুমকি, উদ্বেগ প্রকাশ পর্যটনমন্ত্রীর ]
শুধু তাই নয়, সুভাষচন্দ্র বসু, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভভাই পাটেল, শরৎচন্দ্র বসু, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, খান আবদুল গফর খান, সরোজিনী নাইডু, পদ্মজা নাইডু, ডাঃ আবুল কালাম আজাদ, ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের মতো রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকও হয়েছে সোদপুরের এই আশ্রমে।
কিন্তু এখন ১৫ বিঘা জমির মাত্র মাত্র দুই বিঘা জমি অবশিষ্ট। আশ্রমের মূল ভবনটি ছাড়া বাকি এলাকায় তৎকালীন সরকার কোয়ার্টার গড়ে তুলেছে। মূল ভবনটিও মদ-গাঁজার ঠেকে পরিণত হয়েছিল। আগাছায় ভরে গিয়েছিল আশ্রমের চারদিক। ঘরগুলিতে বাসা বেঁধেছিল উঁইপোকা আর বিষাক্ত সাপ। আশ্রমটি বর্তমানে খাদি প্রতিষ্ঠান ট্রাস্ট বোর্ডের অধীনে। হাতে গোনা কয়েকজন প্রৌঢ় আশ্রমটির দেখাশোনা করেন। অর্থের অভাবে সেটি সংস্কার করতে পারছেন না। বর্তমান বিধায়ক নির্মল ঘোষ ক্ষমতায় এসে তার চারদিকে লোহার পাঁচিল তুলে দেন। সম্প্রতি পানিহাটি পুরসভার কাছে আবেদন জানানো হলে, আশ্রমটি রং করার ব্যবস্থা করা হয়। তবে উইয়ের ঢিবিগুলি ঢাকা পড়েছে কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। সে সময়ের সেলাই, মেশিন, চরকা, তাঁতকল রয়েছে আশ্রমের ঘরে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলি ধ্বংসের পথে।
ট্রাস্টের সম্পাদক অসিতরঞ্জন দাস বলেন, “আশ্রমটি এবং যন্ত্রগুলিকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এত বড় একটা সম্পদ রয়েছে মানুষ জানেই না। আমরা চাই এই আশ্রমটিকে ঘিরে যদি মিউজিয়াম তৈরি করা হয়, তা হলে মানুষ এর ইতিহাসটা জানতে পারবে।” ইতিহাসপ্রেমী ডঃ শেখর শেঠ বলেন, “প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন আশ্রমটিকে সংরক্ষণ করার জন্য তাঁর কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল। উত্তর মেলেনি। মিনিস্ট্রি অফ কালচারে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তাতেও কোনও উত্তর আসেনি।” কেন্দ্রের উদাসীনতায় কার্যত হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন খাদি প্রতিষ্ঠান ট্রাস্ট বোর্ডের সদস্যরা। কিন্তু আবার নতুন করে আশার আলো দেখছেন তাঁরা। সম্প্রতি রাজ্যের পর্যটন দপ্তরের কাছে একটি আবেদন জানানো হয়। এবার উত্তর মিলেছে। আশ্রমটিকে মিউজিয়াম আর প্রদর্শনশালা তৈরি করতে কত খরচ হতে পারে তার খতিয়ান চেয়ে পাঠিয়েছে তারা।
[ দুর্গাপুজোর মণ্ডপের ভিতর ঝুলন্ত দেহ, আতঙ্কে এলাকাবাসী ]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.