বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: বেআইনি জমি দখলের অভিযোগ দেবাশিস প্রামাণিক কাণ্ডের সলতে আট বছর আগেই দলের অন্দরে পাকিয়ে রেখেছিলেন ফুলবাড়ি-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের পূর্ব ধনতলা এবং পশ্চিম ধনতলা এলাকার চার পঞ্চায়েত সদস্য। তাঁরা বেআইনি জমির কারবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট রাজ চালানোর অভিযোগ তুলেছিলেন রাতারাতি ‘বেতাজ বাদশা’ হয়ে ওঠা দেবাশিসের বিরুদ্ধে। দলকে জানিয়েছিলেন, নেতার কুকর্মের জন্য এলাকার বাসিন্দাদের ক্ষুব্ধ হয়ে দল থেকে মুখ ফেরানোর কথা। অভিযোগ, ওই সময় দেবাশিস প্রামাণিকের পাশে দাঁড়ান মন্ত্রী গৌতম দেব। মিথ্যে অভিযোগ তুলে চার পঞ্চায়েত সদস্যকে বহিষ্কার করে পরিস্থিতি সামাল দেন তিনি। বুধবার দেবাশিস গ্রেপ্তার হতে ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির রাজনৈতিক মহলের অন্দরে চালু হয়েছে চর্চা। ভাগ্যের কি পরিহাস! আট বছর পর সেদিনের আপাত নিরীহ অভিযোগ বুমেরাং হয়েছে। তারা এখন ঘটনার পরিনতি দেখার অপেক্ষায়।
সেটা ২০১৬ সাল। ফুলবাড়ি-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের চার তৃণমূল (TMC) পঞ্চায়েত সদস্যের বিদ্রোহের জেরে গোটা ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি (Dabgram Phulbari) উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। কারণ, যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ তার চোখে চোখ রেখে কথা বলা মানেই বিপদ এমন ধারণা ইতিমধ্যে এলাকায় প্রতিষ্ঠিত। তিনি দেবাশিস প্রামাণিক। ২০১১ সালে গৌতম দেবের(Gautam Deb) হাত ধরে তৃণমূলে যোগ দিয়ে ততদিনে জমির বেআইনি কারবারের ‘ডন’ হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ। ফুলবাড়ির ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট অঘোষিত ভাবে তার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। কবে, কোন ট্রাক সীমান্ত পার হবে, কোথায় ট্রাক পার্কিং হবে সবই দেবাশিস বাহিনীর নির্দেশে চলতে শুরু করে। হপ্তা আদায়ের বিরাট কারবার জমে ওঠে। তখন কে বলবে ফুলবাড়ি মোড়ে সামান্য কেরোসিন তেলের ডিলার ছিলেন দেবাশিস! কয়েক লক্ষ টাকার কয়েকটি গাড়ি, রাজ প্রাসাদের মতো বাড়ি। ‘দাদা’-র হাত মাথায় আছে তাই চালচলনেও ছিল বেপরোয়া ভাব। ভূমি রাজস্ব দপ্তর (BLRO) থেকে পুলিশ প্রশাসন তার কথায় চলে এমন ধারণাও তৈরি হয়ে যায়। সেই বেতাজ বাদশার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতে সেদিন যে কাপুনি দলের অন্দরে দেখা গিয়েছিল সেই চোরাস্রোত যেন এখন ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে শিলিগুড়ি শহরেও আছড়ে পড়েছে। কোনও তৃণমূল নেতা ফোন ধরছেন না। অনেকে ফোনের সুইচ অফ করে রেখেছেন।
কিন্তু কী হয়েছিল সেদিন? ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি এলাকার তৃণমূলের কয়েকজন প্রবীণ নেতা ও কর্মী জানান, ফুলবাড়ি-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের পূর্ব ধনতলা এবং পশ্চিম ধনতলা এলাকার চারজন পঞ্চায়েত সদস্যের অভিযোগ ছিল, এলাকার তৃণমূলের নেতারা (দেবাশিস প্রামাণিক ও তার বাহিনী) বিভিন্ন দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। জমি কেনাবেচার (Land) বেআইনি কারবার সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট রাজ চালাচ্ছে। এসব নিয়ে এলাকার বাসিন্দারা ক্ষুব্ধ। দল থেকে মুখ ফেরাচ্ছে। ওই অভিযোগ ঘিরে তৃণমূলের অন্দরে হইচই শুরু হতে প্রামাণিক গোষ্ঠী ওই পঞ্চায়েত সদস্যদের বিরুদ্ধে সরব হয়। নদীর চরে খাস জমি কেনাবেচা, সরকারি প্রকল্পে ঘর পাইয়ে দিয়ে টাকা চাওয়ার মতো বিভিন্ন অভিযোগ তুলে জানায় ওদের সতর্ক করেও লাভ হয়নি। অতএব গৌতম দেবের নির্দেশে তাঁদের বহিষ্কার করা হয়।
এদিকে বিদ্রোহ ঘোষণা করেই চার পঞ্চায়েত সদস্য (Panchayat members) সিপিএমে যোগ দেন। ওরা সিপিএম থেকেই তৃণমূলে গিয়েছিলেন। এলাকাটি জলপাইগুড়ি জেলার অধীন হলেও লাগোয়া হওয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক দিক দেখা হয় শিলিগুড়ি থেকে। দার্জিলিং জেলা সিপিএম সম্পাদক শমন পাঠক বলেন, “২০১৬ সালে চারজন পঞ্চায়েত সদস্য সাহস করে যে অভিযোগ তুলেছিলেন আজকে সেটাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। এখানেই প্রশ্ন দেবাশিস প্রামাণিককে তৈরি করেছে কে! তাদের কেন শাস্তি হবে না!” ওই বিষয়ে অবশ্য তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য মেলেনি। দেবাশিস জলপাইগুড়ি জেলার ডাবগ্রাম ফুলবাড়ির তৃণমূল ব্লক সভাপতি তথা জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদ সদস্য। পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ হওয়ার পর শোনা যায় দেবাশিসের ইচ্ছে ছিল বিধায়ক হবেন। টিকিটের জন্য চেষ্টাও নাকি করেছেন। অথচ কাওয়াখালি, পোরাঝার এলাকায় বিভিন্ন সরকারি জমি এবং মহানন্দা নদীর চর দখল করে বিক্রির মতো বিস্তর অভিযোগ শিলিগুড়ি মেয়র গৌতম দেবের ঘনিষ্ঠ ওই নেতার বিরুদ্ধে।
এখানেই শেষ নয়। রাজনৈতিক মহলের চর্চায় জানা যায়, ২০১৯ লোকসভা, ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ভরাডুবির অন্যতম কারণ ছিল ‘ডন’ দেবাশিসের ‘দাদাগিরি’। গত লোকসভা নির্বাচনে ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রে প্রায় ৬৪ হাজার ভোটে পিছিয়ে ছিলো তৃণমূল। এর পরই দলের অন্দরে দেবাশিসকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। রাজকীয় উত্থান, হঠাৎ ফুলেফেঁপে ওঠা, সিন্ডিকেটরাজ যে সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না সেটা প্রকাশ্যে আসতেই দেবাশিসের বিপদ গর্জেছে। এই দেবাশিসের বিরুদ্ধেই শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ নির্বাচনে ফাঁসিদেওয়া ব্লকের চটহাটে নির্দল প্রার্থীদের প্রচারে বাধা দেওয়া, ফ্লেক্স ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা এবং প্রার্থীদের এলাকা থেকে তাড়ানোর নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ ছিল ৷ এখানেই শেষ নয়। জেলাশাসক, এসডিও, বিডিও-দের তৃণমূলের লোক বলে দাবি করেন তিনি। অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সামাল দিতে দেবাশিসের মন্তব্য দলীয় নেতৃত্বকে সেন্সর করতে হয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.