দিব্যেন্দু মজুমদার: কথায় বলে, মাছে-ভাতে বাঙালি। ঈশ্বরী পাটনি সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার প্রার্থনা করেছিলেন বটে। কিন্তু বাঙালি বাজারের থলে হাতে বেরনো মাত্রই জানেন, সে প্রার্থনায় দুধের বদলে অনায়াসে মাছ শব্দটি বসিয়ে দেওয়া যায়। স্বয়ং রায়গুণাকরও বোধহয় তাতে আপত্তি করবেন না। বাঙালির মাছপ্রীতি এতটাই তীব্র। তবু ইদানীং কালে যেন বাঙালির মৎস্যবিলাস স্রেফ কাটাপোনা আর বরফের মাছেই আটকে গিয়েছে। হরেক মাছের দেখাই নেই। মাছের বিহনে স্বাদের আহ্লাদ নেই বাঙালির পাতেও। মৎস্যবিরহ মাঝমধ্যেই ঘনিয়ে ওঠে বাঙালির হৃদয়ে। কিন্তু উপায় কী! যদি সত্যিই উপায়ের সন্ধান করেন কেউ তবে তবে ঘুরে আসতে পারেন হুগলির আদিসপ্তগ্রামের দেবানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কৃষ্ণপুরে। হরেক মাছের মেলা বসেছে সেখানে।
[ রসগোল্লায় কাঁচালঙ্কার স্বাদ! মিষ্টি যজ্ঞে অবাক রানাঘাট ]
এ মেলা অবশ্য বেশ প্রাচীন। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, মেলার বয়স প্রায় ৫১১ বছর। এবং এই মেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বৈষ্ণব অনুষঙ্গও। কিংবদন্তিটি কী? বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, সেসময় এই এলাকায় গোবর্ধন দাস নামে এক জমিদার ছিলেন। তাঁর একমাত্র সন্তান রঘুনাথ দাসের ধ্যানজ্ঞান ছিল নিত্যানন্দ মহাপ্রভু। তাঁর দর্শনের জন্য মাত্র ১৫ বছর বয়সে গৃহত্যাগী হন রঘুনাথ। গৃহত্যাগের কয়েক বছর পরে রঘুনাথ যখন ফিরে আসেন তখন তাঁর পরিচয় শ্রীমদ রঘুনাথ দাস গোস্বামী। তাঁর প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে কৃষ্ণরামপুরে উত্তরায়ন উৎসবের সূচনা হয়। সারাদিন ধরে নামকীর্তনের পাশাপাশি বিশাল এলাকা জুড়ে মেলা বসে।
[ বাড়িতে ঢুকলেই কেন ফোন খারাপ? ৩০ বার মোবাইল পালটেও নাজেহাল এই ব্যক্তি ]
এদিকে ঘরের ছেলে ফিরে আসার পর স্থানীয় বৈষ্ণবরা রঘুনাথকে বলেন, আমরা সারা বছর ধরে এত সাধনা করে প্রভুর দর্শন পেলাম না, আর তুমি এই বয়সে প্রভুর দর্শন পেলে। তুমি যদি সত্যিই প্রভুর দর্শন পাও, তবে আমাদের ইলিশ মাছের ঝাল আর আমের টক খাওয়াও। লোকমুখে শোনা যায় বৈষ্ণবদের প্রমাণ রাখতে মাঘ মাসের শীতে, অসময়ে পুকুর থেকে ইলিশ মাছ ও গাছ থেকে আম পেড়ে খাওয়ান রঘুনাথ। তারপর থেকেই মেলার সূচনা।
[ বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করল ভাই-বোন, তারপর… ]
আজও সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। আগে মেলায় অন্যান্য সামগ্রীর পাশাপাশি মাছ বিক্রি হত। পরে মাছটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এবং লোকমুখে তা মাছের মেলা বলেই পরিচিত হয়। পাঁচ শতকের রেওয়াজে এবারও বিরাম নেই। শীতের আমেজে মাছের সারি কৃষ্ণরামপুরের মেলার মাঠে। মেলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা রঘুনাথদাস গোস্বামী ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান শৈলেন চক্রবর্তী বলেন, প্রাচীন রীতি মেনে পৌষ সংক্রান্তির সন্ধ্যা থেকে পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে হরিনাম সংকীর্তন চলতে থাকে। আর ১ মাঘ সকাল থেকে বিশাল এলাকা জুড়ে মাঘের মেলা বসে।ঘটনাচক্রে এই স্থান আবার সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মভূমিও বটে।
[ অসুস্থদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার আড়ালে মধুচক্রর আসর, জালে ৭ ]
কী নেই সেখানে! ৫৭ কেজির আড় মাছ থেকে শুরু করে ২৮ কেজির ভেটকি। বিশালাকার গুরজাওলি, রুই কাতলা সবই আছে এই মেলায়। ২৮ কেজির ভেটকি বিক্রি হল ৫০০ টাকা কেজি দরে। আর ৫৭ কেজির আড় বিক্রি হল সাড়ে ২৮ হাজার টাকায়। বাঙালি যে কতটা মাছপ্রিয় এই ছোট্ট পরিসংখ্যানেই বোধহয় তা বোঝা যায়। শুধু তাই নয়, বহু অপ্রচিলত মাছেরও সন্ধান মেলে এখানে। তা বাড়তি পাওনা।
[ পরকীয়ার ‘অপবাদ’ দিয়ে বধূকে গাছে বেঁধে মার ]
তবে বিক্রিবাটা মুখ্য নয় ব্যবসায়ীদের কাছে। শতাব্দীপ্রাচীন এই মেলাকে কেন্দ্র করে বহু মাছ ব্যবসায়ীরা এসে জড়ো হন। বিভিন্ন জেলার ব্যবসার ধরন-ধারণ নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়। ভাগাভাগি হয় সুখ-দুঃখ। ব্যবসা তো নিত্যদিনের। তবু এই সম্মিলটাই মেলার পাওনা বলে বাড়ি ফেরেন ব্যবসায়ীরা। বাঙালির পাতে মাছ, আর ব্যবসায়ীদের হাতে অর্থ-এভাবেই মিলনের আনন্দ আর বাণিজ্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে মাছের এই মেলায়।
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.