সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা গেইলের পাইপলাইন বসানো ঘিরে জটিলতা দেখা দিল পুরুলিয়ার বলরামপুরে৷ পাইপলাইন বসানোর জন্য জমি অধিগ্রহণে গেইলের শর্ত মানতে নারাজ বলরামপুরবাসী৷ যার জেরে থমকে গিয়েছে জগদীশপুর–হলদিয়া–বোকারো–ধামরা গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প৷
২০১৮ সালে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর শিল্পাঞ্চল থেকে গেইলের এই পাইপলাইন বসানোর কাজ শুরু হয়৷ গোড়ার দিকে ওই এলাকাতেও জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল এই সংস্থাকে৷ প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে তা কেটে যাওয়ায় কাজ মসৃণভাবেই হয়ে যায়৷ তবে বলরামপুরের ফের একই সমস্যা দেখা দিয়েছে৷ যা এই মুহূর্তে গেইলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এখানকার কৃষক-সহ জমি মালিকদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সংস্থাটি জমি মালিকদের কাছ থেকে জোর করে, চাষিদের ভুল বুঝিয়ে জমি অধিগ্রহণ করতে চাইছে। অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ বাবদ খুব সামান্য অর্থ দেওয়া হচ্ছে, যা মানতে রাজি নন তাঁরা৷
গেইল নিজের শর্ত থেকে সরে না এলে ‘কৃষক বাঁচাও কমিটি’ গড়ে বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন চাষি ও জমির মালিকরা৷ বৃহস্পতিবার পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনিক ভবনে এই সংক্রান্ত জনশুনানি শেষে একথা জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। আরও জানা গিয়েছে, চলতি মাসের ২২ তারিখ বলরামপুরের ছোট গাদো হরিমন্দিরে এই নিয়ে বৈঠকে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি হবে৷ এদিন জেলা প্রশাসনিক ভবনে জনশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন ছোট গাদো গ্রামেরই প্রায় চারশ বাসিন্দা। ওই শুনানিতে তাঁরা বিশেষ ভূমি অধিগ্রহণ আধিকারিকের কাছে নিজেদের আপত্তি জানান। পুরুলিয়ার জেলাশাসক রাহুল মজুমদারের কথায়, ‘এই সমস্যা মেটাতে জমির মালিক ও গেইলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। যাতে সুষ্ঠুভাবে প্রকল্পের কাজ করা যায়।’
পাইপলাইন বসানোর জন্য গেইল চায় জমি ব্যবহারের অধিকার অধিগ্রহণ। এই অধিগ্রহণে মালিকানা জমির মালিকদেরই থাকবে। ‘জমি ব্যবহারকারীর অধিকার অধিগ্রহন আইন ১৯৬২’-এর শর্ত অনুযায়ী, অধিগ্রহণের পর ওই জমিতে সংশ্লিষ্ট জমির মালিক কোনও বাড়ি নির্মাণ করতে পারবেন না। কোনও গাছ পোঁতা যাবে না৷ কোনও চৌবাচ্চা, ট্যাঙ্ক,কুয়ো, বোর ওয়েল বা পুকুর খুঁড়ে এই ব্যবহারের অধিকার খর্ব করা যাবে না। আবার ‘পেট্রোলিয়াম ও মিনারেল পাইপলাইন আইন ১৯৬২’ অনুযায়ী, শুধুমাত্র ফসল, গাছ ও অন্যান্য সম্পদের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে মালিককে। বলরমপুর এলাকায় এই আইন অনুযায়ী জমি অধিগ্রহণে রাজি হলে, ক্ষতিপূরণ বাবদ খুব সামান্য টাকা পাবেন মালিকরা৷ তাই গেইলের এই শর্ত মানতে নারাজ ছোট গাদো গ্রামের কৃষকরা। বলরামপুর সিপিএমের ব্লক কৃষক সভার সম্পাদক অর্ধেন্দু মাইতি বলেন, ‘আমরা চাই গেইল সম্পূর্ণভাবে জমিটি অধিগ্রহণ করে বাজারমূল্য অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিক৷ তারা যে শর্ত দিচ্ছে, তা মানব না। একপ্রকার ভুল বুঝিয়ে জোর করে জমি কেড়ে নিতে চাইছেন সংস্থার কর্তারা। নানা সরকারি আইন সামনে আনছেন। এমন হলে প্রতিবাদ হবে। আন্দোলন হবে। তবে এই আন্দোলনে কোনও রাজনৈতিক রঙ থাকবে না৷’
কৃষকরা বলছেন, ১২ ইঞ্চি পাইপ বসানোর জন্য ৬৬ ফুট চওড়া জমি চাইছে গেইল। তাঁদের কথায়, কেন্দ্র জমি নিলে যা বাজারদর থাকে, তার চেয়ে অন্তত চারগুণ বেশি দাম পাওয়া যায়। বর্তমানে বলরামপুরের একাধিক গ্রাম সংলগ্ন ধানবাদ–জামশেদপুর ৩২ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে ডেসিমেল পিছু আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা জমির দাম। তবে গেইল রঘুনাথপুর মহকুমা এলাকায় প্রতি ডেসিমেল পিছু আট হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রস্তাব করেছে বলে এই এলাকার কৃষকরা জানিয়েছেন৷ যা বাজারদরের তুলনায় একেবারেই নগণ্য৷ সপ্তাহ তিনেক আগে এই অধিগ্রহণের নোটিস যায়। তবে সেখানে উল্লেখ ছিল, কারও আপত্তি থাকলে বিশেষ ভূমি অধিগ্রহণ আধিকারিকের কাছে জানানো যাবে।
গেইলের পাইপলাইন যে এলাকায় বসবে, তার আওতায় ছোট গাদো ছাড়াও রয়েছে গোবিন্দপুর, বেড়মা, রুচাপ, ভালুবাসা, মালতি, বড়উরমা,,পারষ্যা, ডুমারি, হেতাডি, শ্যামনগর এলাকাও পড়ছে৷ এছাড়া রয়েছে পুরুলিয়া মফস্বলের বেশ কয়েকটি এলাকাও রয়েছে৷ তবে বলরামপুর অঞ্চলে গেইলের প্রকল্পের বিরোধিতা দেখে অবাক হচ্ছে শিল্পমহলের একাংশ৷ শিল্পহীন বলরামপুরে শিল্প চাইবেন বাসিন্দারা, সেটাই স্বাভাবিক চিত্র৷ কিন্তু জমির দাম এতটাই কম পাচ্ছেন তাঁরা যে বিরোধিতার পথে হাঁটতেই কার্যত বাধ্য হচ্ছেন৷
ছবি: সুনীতা সিং৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.