গান গাইছেন শিল্পীরা।
অভিষেক চৌধুরি, কালনা: দু-তিন জন বাদে সকলেই দিনমজুর-খেতমজুর। কেউ-কেউ শিক্ষিত। অধিকাংশের অক্ষরের সঙ্গে পরিতচিত হতে পারেননি। পরিবারে অনটন। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। একদিন কাজ না জুটলেই বিচলিত হন। তবু দিনের শেষে সেই মনেতেই সুর ধরে। রোদে পোড়া সেই শরীরেই ওঠে বিভিন্ন ধরনের সাজ পোশাক। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে গান গেয়ে মাঠে ঘাটে খাটার মত সমান দক্ষতায় তাঁরা আবার বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ও করেন। নেশায় ও রক্তে মিশে থাকা ‘বাদাই গান’ আজও তাঁদের পিছু তাড়া করে। তাই নিজেরাই গান বেঁধে, সুর দিয়ে বছর ভর চর্চা চালিয়ে যান। নভেম্বরের শুরুতেই মন্তেশ্বরের করন্দা গ্রামে পাড়ায়-পাড়ায় ‘বাদাই উৎসব’ মেতে ওঠেন। দু-দিন ধরে চলা সেই গানের চর্চাতেই সমাজ সচেতনতা-সহ সাংস্কৃতিক চেতনায় এলাকাবাসীকে উৎসাহিত করে চলেছেন চল্লিশ জন মেঠো শিল্পীর দল।
প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকগান ‘বাদাই’। গ্রামীণ এলাকার প্রেম-প্রকৃতি, সামাজিক ও জীবনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সেই গান রচনা করা হয়। একসময় গ্রামবাংলায় বাদাই গানের রমরমা থাকলেও বর্তমানে তা বিলুপ্তপ্রায়। মন্তেশ্বরের করন্দা গ্রামে এই গান একসময় চালু থাকলেও মাঝখানে চর্চার অভাবে তা বন্ধও হয়ে যায়। কিন্তু প্রায় দেড় দশক আগে থেকে সেই গানের চর্চা করে আবার সেই জনপ্রিয় ‘বাদাই’ কে ফিরিয়ে আনেন বংশপরম্পরায় এই গানের সঙ্গে যুক্ত পেশায় খেতমজুর পশুপতি দাস, বিষ্ণু দাসের মত গ্রামের একাধিক শিল্পীরা। তাঁদের সঙ্গেই গান গাওয়া ও অভিনয়তেও সমান পারদর্শী হয়ে ওঠেন দিনমজুর কালীরাম রাজবংশী, স্বরূপ সাঁতরা, অশোক হাজরারা।
তা দেখে পিছিয়ে থাকেননি এলাকার বাসিন্দা ও ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়র উজ্বল দে, গৃহশিক্ষক দেবজিৎ মুখোপাধ্যায়, তন্ময় দে-র মত গান রচনাকারী ব্যক্তিরা। বর্তমানে তাঁদের রচিত গানে সুর দিতে সমান দায়িত্ব পালন করেন বিকাশ পাল, অনুপ চক্রবর্তীরা।
করন্দা গ্রামে মঙ্গলবার থেকে দুদিন ধরে চলা বাদাই উৎসবের পরিচালনার দায়িত্বে থাকা শিক্ষক সুদীপ মণ্ডল ও রাজীব মুখোপাধ্যায় জানান, উৎসবে প্রতিদিনই দশটি দলে ভাগ হয়ে গ্রামের চৌদ্দো পাড়ায় একক, ডুয়েট, আবার কোথাও ৩-৪ জন শিল্পী বাদাই গান গাওয়ার পাশাপাশি অভিনয় করেছেন। পৌরাণিক থেকে রাধাকৃষ্ণ, রোমান্টিকতা থেকে সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষামূলক থেকে ব্যাঙ্গাত্মক গান গেয়ে গ্রামজুড়ে সংস্কৃতি চর্চা করে চলেছেন এইসব শিল্পীরা।
মাঠেঘাটে খাটা দিনমজুর-খেতমজুর পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকা এই সব মানুষজনই একসময় গানও রচনা করতেন। বর্তমানে সেই গানে সুর দিয়ে গান গেয়ে, অভিনয় করে বছরভর চর্চা করেন তাঁরা। দিন আনা, দিন খাওয়া পরিবারের এই মানুষজন রুটিরুজির টানে দিনভর মাঠেঘাটে ছুটলেও দিনের শেষে আজও তাঁরা সাংস্কৃতিক চেতনায় এলাকার মানুষকে উৎসাহিত করেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.