দেব গোস্বামী, বোলপুর: সেই কবে কোন মনকেমন করা উদাস প্রকৃতির কোলে বসে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’। বাংলা সাহিত্যের এই অরূপ রতন আজও তোলপাড় ফেলে দেয় সাহিত্যপ্রেমীদের হৃদয়ে। কিন্তু বদলে যাওয়া সময়ের সরণিতে বড় ফিকে হয়ে যাচ্ছে সেই হাঁসুলি বাঁক। বদলে যাচ্ছে লাভপুরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতভিটে। প্রশাসনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে প্রকাশ্যে চলছে অবৈধভাবে বালির তোলার কাজ। উপন্যাসের কুয়ে নদীর হাঁসুলির বাঁক এখন বালি মাফিয়াদের দখলে! কথা সাহিত্যিকের স্মৃতিবিজড়িত হাঁসুলি বাঁক দিন দিন ভৌগোলিক বৈচিত্র হারাচ্ছে বলেও অভিযোগ স্থানীয়দের। ক্ষুব্ধ জেলার সাহিত্যপ্রেমী ও সংস্কৃতি কর্মীরা। হতাশ লাভপুরবাসীও।
আজও গোটা বাংলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় বীরভূমের এই হাঁসুলি বাঁক। ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনে হবে, এ যেন অশ্বক্ষুরাকৃতি নদীর পথের ঠিক আগের অবস্থা। তারাশঙ্কর তাঁর লেখায় নদীটিকে মেয়েদের হাঁসুলি হারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আসলে কোপাই নদীর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় বিখ্যাত বাঁকের নাম হাঁসুলি বাঁক। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে উপন্যাসের রচনা এবং ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়। তার পর থেকে হাঁসুলি বাঁকের উপকথা উপন্যাস দেশ-বিদেশে নাম ছড়িয়ে পড়ে।
তবে পরিকাঠামোর অভাবের জন্যই এই হাঁসুলি বাঁক দীর্ঘদিন ধরেই অগোছালো। দূরদূরান্তের পর্যটক ও সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটা স্বপ্নের মত। সেই সুবাদেই সারা বছরই জেলায় আসেন পর্যটকরা। আসেন সাহিত্যিক ও গবেষকরাও। উল্লেখ্য, লাভপুরের পর্যটন সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই হাঁসুলি বাঁকের সৌন্দর্যায়নের জন্য একগুচ্ছ প্রকল্প নেয় জেলা প্রশাসন। লাভপুরের বিধায়ক তথা জেলা তৃণমূলের কোর কমিটির সদস্য অভিজিৎ সিংহ বিধানসভায় এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণও করেন। যেখানে নজরমিনার, রাত্রিবাসের কটেজ,পার্ক ক্যাফেটেরিয়া-সহ নানা প্রকল্প নেওয়া হয়। আনুমানিক ১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকার বাজেট পাঠানো হয়েছে রাজ্য সরকারকে।
কিন্তু প্রশাসনেরই নজরদারির অভাবে বালি মাফিয়ারা অবাধে হাঁসুলি বাঁকের গর্ভ থেকে বালি এবং মাটি পাচার করে চলেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। আর সবকিছু দেখেও স্থানীয় ব্লক প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন নীরব। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়,হাঁসুলি বাঁকের ঐ জায়গায় কোনও বৈধ বালিঘাট নেই। তবে কিভাবে, কার মদতে দিনের পর দিন ধরে প্রকাশ্যে অবৈধভাবে বালি তুলছে মাফিয়ারা, তা জানা নেই। বহু ট্রাক্টর নদীর পাড় কেটে নদীতে নেমে অবৈধভাবে বালি পাচার হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। আর বিক্রিও হচ্ছে চড়া দামে।
জেলার সাংস্কৃতিক কর্মী উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় ও কেদারনাথ আচার্যরা বলছেন, “আমরা চাই প্রশাসন যথার্থ সংরক্ষণ করুক। এবং শীঘ্রই পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠুক।” লাভপুরের তৃণমূলের ব্লক সভাপতি তরুণ চক্রবর্তী জানান,”হাঁসুলি বাঁক থেকে অবৈধ বালি ও মাটি পাচার অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন কোনওভাবেই তা হারিয়ে না যায়, প্রশাসনকে অনুরোধ জানাব। আগামী দিনে হাঁসুলি বাঁকের সৌন্দর্যায়নের পাশাপাশি ভৌগলিক বৈচিত্র রক্ষার্থে যথাযথ পদক্ষেপ করা হবে।” লাভপুরের বিডিও শিশুতোষ প্রামাণিকের কথায়, “নজরদারির অভাবের কথা সঠিক নয়। তবে এই অভিযোগ আমরা পেয়েছি। প্রশাসনিক স্তরে সরোজমিনে নজরদারির পাশাপাশি তদন্ত করা হবে। নেওয়া হবে আইনানুগ ব্যবস্থাও।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.