জিনাতের শিকার ছাগল। ছবি: অমিতলাল সিং দেও।
সুমিত বিশ্বাস ও অমিত সিং দেও, পুরুলিয়া ও মানবাজার: বনদপ্তরের মহিষ, শূকর, ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট – কোনও টোপই গিলল না। তিনদিন ভুখা থাকার পর রাইকা পাহাড়তলির রাহামদা গ্রামে নিজে সুস্বাদু বাংলার কালো ছাগল শিকার করে পেট ভরাল ওড়িশার বাঘিনী জিনাত। তৃতীয় দিনে তার শিকার ৫টি ছাগল। এর মধ্যে একটি ৩০ কেজি ছাগলের কোমরের অর্ধেকাংশ ছাগলের দেহ খেয়ে নিয়েছে সে। সবকটি ছাগলের দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের পাঠানো হয়েছে। অনুমান,
ভোরের দিকে রাইকা গ্রামীণ সড়ক পার করে রাহামদা গ্রাম সংলগ্ন রাইকা পাহাড়ের অন্য অংশে ঢোকে জিনাত। দুদিন পেরিয়ে তৃতীয় দিনেও কিন্তু বাঘিনীকে বাগে আনা যায়নি। নিজের মর্জিমাফিক চলে এখনও অধরা ওড়িশার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।
আসলে তাকে খাঁচা বন্দি করতে এযাবৎকালে সব কৌশলই ব্যর্থ হয়েছে। তাই মঙ্গলবার বান্দোয়ানে বনদপ্তরের অতিথি আবাসে বনকর্তারা বৈঠকে বসেছিলেন নতুন কোনও কৌশল অবলম্বন করা যায় কিনা। কিন্তু সেই বৈঠক থেকে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, বাঘিনীর মর্জিমতোই চলবেন রাজ্য বনবিভাগ-সহ সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের আধিকারিকরা। ফলে জিনাতকে খাঁচাবন্দি করতে সামান্যতম ব্যাঘাত ঘটানো তো দূর অস্ত, কোনওরকম তাড়াহুড়ো করবেন না তাঁরা। আপাতত যতদিন পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের রাইকা পাহাড়ে থাকবেন সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের আধিকারিকরা, বাঘিনীকে তাকে ট্র্যাক করে যাবে।
জানা যাচ্ছে, সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে ঘরছাড়া হওয়ার পর জিনাত ক্রমাগত হাঁটলেও বান্দোয়ানের রাইকায় প্রবেশ করে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। টোপের কাছে গিয়েও সে ফিরে আসছে। মাঝেমাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে। জিনাতের এমন আচরণে দুটি বিষয় সামনে আসছে –
১. মহারাষ্ট্রের তাডোবা-আন্ধেরি ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে ওড়িশার সিমলিপালে আসা জিনাত ভীষণই সতর্ক।
২. যেভাবে তাকে এক মাস ধরে পিছু করা হচ্ছে তার খানিকটা আঁচ পেয়ে সে ভিত সন্ত্রস্ত!
তাই জিনাতের ইচ্ছের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সব বিষয়। রাজ্যের মুখ্য বনপাল (দক্ষিণ-পশ্চিম চক্র) বিদ্যুৎ সরকার বলেন, “বাঘিনীটি এক থেকে দেড় কিমির মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। টোপের কাছাকাছি এলেও তা গিলতে চাইছে না। খাঁচাবন্দি করতে যেসব পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল তা ফলপ্রসূ হয়নি ঠিক। কিন্তু তার বাইরে আমরা কোনও স্ট্র্যাটেজি বদল করছি না। ওর মর্জিমাফিক আমরা চলব।”
বনদপ্তর জানাচ্ছে, ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়ায় থাকার সময় জিনাত পেট ভরে খেয়েছিল (Full meal)। অর্থাৎ, সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের টোপ হিসাবে দেওয়া মহিষ খেয়েছিল। কিন্তু তাকে খাঁচাবন্দি করা যায়নি। কারণ, বাঘের মত বন্যপ্রাণরা একটি শিকারকে একবারে খায় না। নিজের ডেরা থেকে আবার ফিরে এসে খায়। সেই কারণেই খোলা আকাশের নিচে ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়ায় একটি মহিষকে বেঁধে রেখেছিল সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। তারা চাইছিল, ওই খাবার খেতে আসার সময় তাকে ঘুমপাড়ানি গুলিতে কাবু করা হবে। কিন্তু জিনাত শিকারের কাছে দুবার ফিরে এলেও ওই সেই চেষ্টা সফল হয়নি। তাই জিনাত রাইকা পাহাড়ে আসার পর কৌশল বদলে খাঁচায় টোপ দেওয়া হয়। ভাবনা ছিল, ওই টোপ গিলতে চাইলেই সেই খাঁচায় বন্দি হয়ে যাবে।
কিন্তু এই কৌশলও হতাশ করেছে বন আধিকারিকদের। মুখ্য বনপালের (দক্ষিণ-পশ্চিম চক্র) কথায়, “একটা পূর্ণবয়স্ক বাঘ ফুল মিল করলে ছ-সাত দিন থেকে যায়। আমাদের ধারণা, রাইকার জঙ্গলে কোনও না কোনও ছোটখাটো শিকার সে করছে। যেটা সবসময় আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। আর সেই কারণেই ও দিব্যি রয়েছে।” রাইকা পাহাড়ের একেবারে ভিতরে ঘন জঙ্গলে পর্যাপ্ত জল না থাকলেও বিভিন্ন ঝোরা থেকে আসা জল দুটি পুকুরে পড়ে। এছাড়া ওই পাহাড়ের জঙ্গলের বাইরে একটি চেক ড্যাম রয়েছে। সবমিলিয়ে, বাঘ থাকার ভীষণই অনুকূল পরিবেশ এই রাইকা পাহাড় তা মেনে নিয়েছেন বনকর্তারা। তাছাড়া এই পাহাড়ে একাধিক গুহা রয়েছে। রয়েছে নেকড়ে, বন্য শূকর, হরিণের মতো বন্যপ্রাণও।
সোমবার রাতে তার ভুখা পেটে থাকার সুযোগকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষ থেকে রাজ্যের বনবিভাগ। তাই সোমবার সন্ধ্যার আগেই তিন-তিনটি টোপ প্রস্তুত করে রাখে। অর্থাৎ রাতের মেনু রেডি করার পাশাপাশি প্রস্তুতিতে থাকে ঘুমের ওষুধও। অর্থাৎ খাঁচাবন্দি গাড়িতে ছদ্মবেশে গায়ে লতাপাতা জড়িয়ে জঙ্গলের ভিতরে আত্মগোপন করে থেকে ঘুমপাড়ানি গুলিতে কাবু করা যায়। কিন্তু সেই চেষ্টা বিফলে যায়। যে এলাকায় জিনাত রয়েছে সোমবার রাতে সেখানে বন দপ্তরের ৩০টি টিম জঙ্গল কর্ডন করে রাখে। ইতিমধ্যেই ওই জঙ্গল ঘুরে যান রাজ্যের মুখ্য বনপাল (দক্ষিণ-পশ্চিম চক্র) বিদ্যুৎ সরকার, পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশ সুপার বলেন, “পুলিশ যেমন মাইকিং করে সাধারণ মানুষজনদেরকে সতর্ক করছে। তেমনি রাইকা পাহাড় লাগোয়া গ্রামগুলির বাড়ি বাড়ি গিয়ে সতর্ক করছেন সিভিক ভলান্টিয়াররা। সচেতনতার প্রচারে বনদপ্তরকে সহায়তা করার কথাও বলা হয়েছে।”
এদিকে ওই বাঘিনীর ভয়ে ওই পাহাড় লাগোয়া একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জুনিয়ার হাই স্কুলের ঝাঁপ বন্ধ। রাইকা পাহাড়ের অধিকাংশ এলাকা শ্যাডো জোন থাকায় জিনাতের অবস্থান সব সময় বোঝা যাচ্ছে না। তাই পুরুলিয়া-বাঁকুড়া মিলিয়ে ৮টি ট্র্যাপ ক্যামেরা আনা হয়। এদিন থেকেই তা লাগানো হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.