প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় স্মৃতিচারণায় প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী।
অটলবিহারী বাজপেয়ী আমার দেখা সর্বকালের সেরা প্রধানমন্ত্রী। ৩১টি দলের কোয়ালিশন গভর্মেন্ট চালিয়েছিলেন। কিন্তু কখনও শুনিনি যে, শরিক দলের কোনও নেতা তাঁর বিরুদ্ধে কখনও কথা বলেছেন। তাঁর মস্ত বড় গুণ ছিল, সকলের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করা। তা না হলে তাঁর পক্ষে ৩১টি দলের কোয়ালিশন গভর্মেন্ট চালানো সম্ভব হত না। সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন। তিনি কখনও নিজের মত কারও উপর চাপিয়ে দিতেন না। তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল ৩১টি দলের সরকার চালানো। তিনি আলোচনা করতেন। সব শেষে তাঁর মত প্রকাশ করতেন। আজকালকার দিনের রাজনীতিতে এই জিনিসটার খুব অভাব বোধ করি।
অটলবিহারী বাজপেয়ী খুব উঁচু দরের রাজনীতিবিদ ছিলেন। সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর আন্ডারে কাজ করার। চারটি দফতর ছিল আমার হাতে। স্পেস, অ্যাটোমিক এনার্জি, প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেনটেশন এবং প্ল্যানিং। মনে পড়ছে, তিনি তখনকার স্পিকারকে একটা চিঠি লিখেছিলেন, যে এই চারটি দপ্তরের কোনও প্রশ্ন সংসদে উঠলে আমার মিনিস্টার অফ স্টেট তার উত্তর দেবেন। এতবড় একটা গুরুদায়িত্ব তিনি প্রথমবারের সাংসদ ও মন্ত্রীর উপর ছেড়ে দেন। এটা আমার কাছে খুব গৌরবের বিষয়। মনে আছে, সংসদে প্রশ্ন উঠলে তারজন্য ব্রিফিং হত। ব্রিফিংয়ে ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি থাকতেন। আমি থাকতাম। বাজপেয়ীজি থাকতেন। তিনি উত্তর কারও উপর চাপাতেন না। তিনি সবার বক্তব্য শুনে তাঁর মন্তব্য দিতেন। যখন আমার দপ্তরের কোনও প্রশ্ন উঠত এবং ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্তের দরকার ছিল সেই সময় তিনি আমায় ক্যাবিনেট মিটিংয়ে ডেকে পাঠিয়ে মতামত জিজ্ঞাসা করতেন। মনঃপুত হলে গ্রহণ করতেন। তাঁর পলিসি ছিল সবাইকে শোনা। তাঁর পর নিজের মন্তব্য করা।
[চলে গেলেন ভারতীয় রাজনীতির পিতামহ, কে পড়াবেন রাজধর্মের পাঠ?]
যে কোনও বিষয়ে তাৎক্ষণিক বক্তৃতা দিতে পারতেন অসাধারণভাবে। সংসদে একবার একটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় বিরোধী দলের নেতারা হই হট্টগোল করে আমায় থামিয়ে দেন। বিরোধীদের উদ্দেশ্য ছিল বাজপেয়ীজির মুখে উত্তর শোনা। সেই সময়ই বাজপেয়ীজি সংসদে আসেন। প্রশ্নের উত্তর দেন। যে উত্তর শুনে বিরোধীরাও সন্তুষ্ট হয়ে যায়। তিনি কখনও কাউকে ছোট মাপের লোক ভাবতেন না। সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করার দক্ষতা তাঁর ছিল। এতবড় মাপের রাজনীতিবিদকে হারিয়ে বিজেপির যে লোকসান হল, সেটা পূরণ করা সম্ভব নয়। আমার মনে হয় না ওই স্ট্রাকচারের রাজনীতিবিদ আর কেউ আছে বলে।
তাঁর সবথেকে বড় কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা। গ্রামে গ্রামে যোগাযোগ তৈরি। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়ার জন্য রাস্তা করে দেওয়া। আর একটা বড় সাফল্য সোনালি চতুর্ভুজ। দিল্লি থেকে মুম্বই। মুম্বই থেকে চেন্নাই। চেন্নাই থেকে কলকাতা। নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন। বাংলার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও ছিল অনেক গভীর। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যেখানে যেখানে গিয়েছেন, নিজের হাতে ব্যাগ বয়ে নিয়ে সেখানে গিয়েছেন। রাজ্যে এলে বড়বাজারে থাকতেন। খেতে খুব ভালবাসতেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে খোলামেলাভাবে মিশতেন। উনি একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি ১৯৯৯ সালে কৃষ্ণনগরে আমার হয়ে প্রচারে এসেছিলেন। আর কোনও প্রধানমন্ত্রী কৃষ্ণনগর যাননি। মোদিজি গিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হননি। উনি বেঁচে ছিলেন, এটাই যথেষ্ট ছিল। অনুপ্রেরণা জোগাবার জন্য। ৮৬ বছর বয়স হয়ে গেল আমার। মিনিস্ট্রি যাওয়ার পর আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। সালটা ২০১০ নাগাদ। আমার সামনে একটা চেয়ারে তাঁকে বসিয়ে দিয়ে গেল। উনি চিনতেও পারলেন না। শুধু তাকিয়ে ছিলেন। সেই শেষ দেখা। তারপর আর দেখা বা কথা হয়নি। সেই দিনটা খুবই কষ্ট দিয়েছে। আজও ভুলতে পারিনি। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে শোকাহত। দিল্লি যাওয়ার ইচ্ছা আছে। শেষকৃত্যে যাতে থাকতে পারি।
[প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী, শোকস্তব্ধ দেশ]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.