দেবব্রত মণ্ডল, বারুইপুর: গাছে গাছে ফুটে আছে গরান, বাইন, গেঁওয়া, খোলসে ও সুন্দরীরা। ভনভন করে উড়ছে মৌমাছির দল। বইছে দখিনা বাতাস। প্রকৃতিই জানান দিচ্ছে, সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের সময় সমাগত। আর তাই মউলিদের ছটফটানিও বাড়ছে। কারণ, সকলেই যে ঘরবন্দি এখন। কেউ এবার বের হতে পারবেন না মধু সংগ্রহের কাজে। ইতিমধ্যেই সেই নির্দেশিকাও দিয়েছে বনদপ্তর। আর তাই সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ নিয়ে দেখা দিয়েছে আশঙ্কা। মধু পাওয়া যাবে কী করে? লকডাউন উঠে গেলে চাহিদামতো মধুর যোগান আসবেই বা কোথা থেকে? একদিকে যেমন আশঙ্কায় বনদপ্তর, অন্যদিকে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি কয়েকশো মউলের দল।
সুন্দরবনে প্রতি বছর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় মধু সংগ্রহের কাজ। মাসখানেক ধরে তা চলে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে। উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, এমনকী অন্যান্য জেলা থেকেও কয়েকশো মউলি গিয়ে হাজির হন সুন্দরবনের জঙ্গলে। প্রথমে বনবিবির মন্দিরে পুজো দিয়ে তাঁরা নৌকায় চড়ে শিঙায় ফুঁ দিয়ে চলে যান জঙ্গলে। কিন্তু এবছর ভিন্ন পরিস্থিতি। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে তৃতীয় দফা লকডাউন চলছে দেশজুড়ে। তাই কেউই এবার আর পৌঁছাতে পারবেন না সেই জঙ্গলের মধু সংগ্রহের কাজে।
লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর প্রথমদিকে বনদপ্তর ভাবনাচিন্তা করেছিল যে মধু সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে। কিন্তু আমেরিকার চিড়িয়াখানায় যখন করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়ে এক বাঘিনী, তখনই বনদপ্তর সিদ্ধান্ত নেয় যে আর মধু সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হবে না জঙ্গলে। কোনও মধু সংগ্রহকারীকে যেমন ঢুকতে দেওয়া হবে না, তেমনি মাছ কাঁকড়া সংগ্রহকারী কাউকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না জঙ্গলে। কারণ মানুষের থেকেই বাঘের বা অন্যান্য জঙ্গলের প্রাণীর শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। আর তাই এ বছর আর মিলল না মধু সংগ্রহের অনুমতি।
সুন্দরবনের জঙ্গল থেকে প্রতিবছর কয়েকশো মেট্রিক টন মধু সংগ্রহ করা হয়। মোম ও আসে প্রায় সম পরিমাণে। মোম সাধারণত মধুর থেকেও বেশি দামে বিক্রি হয়ে যায় বিভিন্ন ক্রিম তৈরির কারখানা তে। সুন্দরবনের মধুর খ্যাতি ভারত তথা বিশ্ব জোড়া। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এই মধু রপ্তানি হয়ে থাকে। কিন্তু এ বছর আর সেই মধু রপ্তানি করা যাবে না এমনটাই মনে করছে বনদপ্তর। সরকার নির্ধারিত দামেই মউলেদের থেকে মধু কিনে নেওয়া হয় প্রতি বছর। তবে মোমগুলি মউলিরা নিজেরাই বাইরে বিক্রি করে দেয়। আর এ বছর এই মধু সংগ্রহ করতে না পেরে বহু মউলেরা পড়েছেন আর্থিক ক্ষতির মুখে। সুন্দরবনের চাক ভাঙা মধু যেমন পাওয়া যাবে না তেমনি পাওয়া যাবেনা বাক্সবন্দি মধুও।
এ বিষয়ে মধু সংগ্রহকারী মহিউদ্দিন শেখ বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে এই মধু সংগ্রহের কাজ করে আসছি সুন্দরবনের জঙ্গলে। এরকম সমস্যা কোনদিন হয়নি।আমরা যেমন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হলাম তেমনি মধু বিক্রি করে সরকারের যে লাভ হত সেই লাভ থেকেও সরকার বঞ্চিত হল।
এ বিষয়ে ব্যাঘ্র প্রকল্পের অতিরিক্ত ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টর অনিন্দ্য গুহ ঠাকুরতা বলেন, জঙ্গলের আশপাশের মানুষজন কে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশের ব্যাপারে একেবারেই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কারণ, করোনা শুধু মানুষের হচ্ছে না, বাঘের শরীরেও এর উপস্থিতি দেখা গেছে। সুন্দরবনের বাঘ বাঁচানোর লক্ষ্যেই অনেক রকম কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আর সেই ভেবেই মধু সংগ্রহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.