সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়,দুর্গাপুর: অসম চ্যালেঞ্জ ছিল৷ তবে সেই চ্যালেঞ্জকে উতরে যাওয়ার সাহসও ছিল অদম্য। ভবিষ্যতে স্রেফ গান গেয়েই দৃষ্টিমানদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে তৈরি এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় দৃষ্টিহীন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সম্ভবত প্রথম দুর্গাপুরের শুভদীপ মণ্ডল।
জন্মান্ধ বলেই দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার কর্মী বাবা আদিত্য মণ্ডল ছেলেকে প্রথম থেকেই কলকাতার নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করেন। প্রথম শ্রেণি থেকেই। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি শুভদীপকে। একের পর এক চমক। মাধ্যমিক পরীক্ষার টেস্টে আশানুরূপ ফল হয়নি। ৮০.৪০শতাংশ নম্বর পেয়ে হতাশ হলেও আশা ছাড়েননি। সব বিষয়ে ৯০ শতাংশ নম্বরের লক্ষ্যে শুরু করেন কঠোর পরিশ্রম। ফলও পেল হাতেনাতে। একলাফে ৯০.৭১ শতাংশ মাধ্যমিকে। অঙ্কে ১০০ থেকে মাত্র ১ নম্বর কম। অন্যান্য বিষয়ে সবকটিতেই নম্বর ৯০ শতাংশের বেশি। মোট প্রাপ্ত নম্বর ৬৬৩। জন্মান্ধ হয়ে দৃষ্টিমানদের চ্যালেঞ্জ করার প্রথম সোপান এভাবেই পেরিয়ে গেল শুভদীপ৷
কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিল শুভদীপ? স্কুলে দৈনিক ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা গ্রুপ স্টাডি ছিল রুটিন। এরপর দৈনিক ২ থেকে ৩ ঘণ্টা ধরে সেই পড়াশোনাকেই নিজের মতো করে ঝালিয়ে নিত। আর এতেই কেল্লাফতে বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্র শুভদীপ মণ্ডলের। ছোট থেকেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি তার আগ্রহ। মান্না দে প্রিয় গায়ক। তার আদর্শ অরিজিৎ সিং৷ কিবোর্ড বাজাতেও সমান দক্ষ শুভদীপ। অন্য সময় উপন্যাস পড়ারও শখ তার। অরিজিৎ সিংয়ের মত জনপ্রিয় গায়ক হওয়ার লক্ষ্যে বছর তিনেক ধরে স্বপ্ন দেখাও শুরু।
এতো ভাল রেজাল্ট হওয়ার পরও কিন্তু বড় হয়ে গায়ক হতে চায় শুভদীপ। এখানেও সেই অতীতের সযত্নে লালন করা চ্যালেঞ্জই লক্ষ্য। চক্ষুষ্মানদের সঙ্গে নিজেকে এক আসনে বসার জেদ। ভবিষ্যতে কী হতে চাও? প্রশ্ন শুনেই সে বলে,‘ বড় গায়ক হতে চাই। যাতে দৃষ্টিমানদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারি। এখনও আমাদের সমাজে বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের অন্য চোখে দেখা হয়। সেই ধারণা ভাঙতেই আমাকে গায়ক হতে হবে।’ আরও এক ইচ্ছা আছে অবশ্য শুভদীপের৷ ইংরেজির অধ্যাপক হওয়ার ইচ্ছা তার। কিন্তু এই চোখধাঁধানো ফলের পরও অভিভাবকরা কি ছেলেকে গায়ক হতে উৎসাহিত করবেন, নাকি কেরিয়ারের পথে ঠেলে দিতে চাইবেন? শুভদীপের বাবা আদিত্য মণ্ডল জানান, ‘ওর ইচ্ছাকে মর্যাদা দেওয়াই আমাদের কর্তব্য।’ দুর্গাপুর ইস্পাতনগরীর সি-জোনের শান্তিপথের বাসিন্দা শুভদীপের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন মা তনুশ্রী মণ্ডলও। তিনি জানান, ‘ছোট থেকেই ওর ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়েছি আমরা। ও যদি গায়ক হতে চায় তবেও আমাদের কোনও আপত্তি নেই। তবে এখনও ছোট তো বড় হলে তখন দেখা যাবে ও কী চাইছে।’ এই সাফল্যের জন্য কাদের বেশি কৃতিত্ব দেবে শুভদীপ? সে জানায়,‘বাবা-মার ত্যাগ স্বীকারকে কোনও দিনও ভুলতে পারব না। এছাড়াও স্কুলের শিক্ষক, দাদারাও মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করেছেন।’ আগামী দিনে গানেই ভুবন ভরিয়ে দিতে প্রস্তুত এবারে দৃষ্টিহীন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রথম শুভদীপ মণ্ডল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.