ইন্দ্রজিৎ দাস: খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি৷ বিষ্ণুপুর মল্লরাজ পরিবারের এক পুরুষ বসন্ত সিংহ দেব তাঁর পরিবার ও বেশ কিছু লোকজন নিয়ে এসে বসবাস শুরু করলেন বিষ্ণুপুর থেকে বেশ কিছুটা দূরে জয়পুর জঙ্গল সংলগ্ন কুচিয়াকোলে৷ কুচিয়াকোলও তখন ঘন জঙ্গল৷ জঙ্গল কেটে তৈরি হল চাষজমি৷ তৈরি হল রাজপ্রাসাদ৷ যা আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত৷ বিশাল চওড়া লাল রঙের দেওয়াল পড়ে রয়েছে স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে৷ রাজপ্রাসাদ তৈরির সঙ্গে গড়া হয়েছিল ঠাকুরদালানও৷ সেই ঠাকুরদালান অবশ্য আজও অটুট৷ এই ঠাকুরদালানে প্রায় চারশো বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে হয়ে চলেছে কুচিয়াকোলের মল্লরাজবাড়ির দুর্গাপুজো৷
এই বাড়িতে কোনও দুর্গামূর্তির পুজো হয় না৷ পুজো হয় পটে আঁকা দুর্গার৷ ঠাকুরদালানের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পটদুর্গাকে রাখা হয়৷ বিষ্ণুপুর মল্লরাজবাড়ির মতো তিনটি পটদুর্গার পুজো হয় না৷ আয়তাকার পটদুর্গাটি প্রায় চার ফুট উচ্চতার ও প্রস্থে প্রায় তিন ফুট৷ অসাধারণ সুন্দর এই দুর্গাপটটি৷ অসুরদলনী দশভুজা মা দুর্গা লাল রঙের শাড়ি পরিহিতা৷ মাথার মুকুট থেকে শুরু করে হাতের গহনা ও অস্ত্র সবই আঁকা৷ মায়ের একদিকে লক্ষ্মী, গণেশ ও আরেকদিকে সরস্বতী, কার্তিক ওপর-নিচে করে রয়েছেন৷ মায়ের মাথার ওপর রয়েছেন মহাদেব, নন্দীভৃঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে৷ বিষ্ণুপুরের ফৌজদার পরিবার বংশপরম্পরায় বিষ্ণুপুর মল্লরাজবাড়ির সঙ্গে কুচিয়াকোলের মল্লরাজবাড়ির দুর্গাপট এঁকে চলেছেন৷ বিষ্ণুপুরের শাঁখারি বাজারের এই ফৌজদার পরিবারই বিষ্ণুপুর মল্লরাজাদের বিখ্যাত দশ অবতারের তাস খেলার তাস তৈরি করেন৷
দেবীপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে বেলতলায় গন্ধ অধিবাসের মধ্য দিয়ে এই বাড়ির পুজো শুরু হয়৷ সপ্তমীর সকালে কাপড়ের দোলায় নবপত্রিকাকে তেলি বাঁধে স্নানে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ওখানে নবপত্রিকা পুজোর সময় তোপধ্বনি করা হয়৷ সেখানে অন্নভোগ দেওয়া হয়৷ তারপর ঢোল বাজিয়ে নবপত্রিকাকে নিয়ে আসা হয় ঠাকুরদালানে, রাখা হয় দুর্গাপটের পাশে৷ পুজোয় এ বাড়িতে ঢাক বাজে না, বদলে ঢোল বাজানো হয়৷
একসময় বাঁকুড়া জেলার এই জয়পুর জঙ্গল ছিল কুচিয়াকোল মল্লরাজ পরিবারের অধীন৷ চাষের আয় ছাড়াও জঙ্গলের সম্পদ ছিল আয়ের মূল উৎস৷ আজ রাজত্ব নেই, রাজাও নেই, তবুও চারশো বছর ধরে চলা গ্রামের মানুষের দেওয়া পুজোর উপকরণে মা দুর্গার পুজো আজও হয়ে চলেছে৷ যেমন, পুজোর পদ্ম আজও আসে মাঝি পরিবার থেকে, পুজোর ফুল মালাকার পরিবার থেকে, বিনিময় তাদের কিছু পারিশ্রমিক দেওয়া হয়৷ আর পুজোর পুরোহিত, তোপদ্বার থেকে শুরু করে পরিচারিকা পর্যন্ত চলছে বংশপরম্পরায়৷
জমিদারির স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে মায়ের পাশে একটা তরবারি রাখা থাকে আর থাকে ছোট একটা কামান৷ অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে সেই কামান থেকে আজও তোপধ্বনি করা হয়৷ সারা গ্রাম জানতে পারে রাজবাড়িতে শুরু হয়েছে সন্ধিক্ষণের পুজো৷ তবে এই কামান দাগা হয় বিষ্ণুপুর মল্লরাজবাড়ির তোপধ্বনির পর৷ মায়ের পাশে তরবারি থাকলেও এখানে পুজোয় কোনও বলি হয় না৷ পুজো হয় সম্পূর্ণ বৈষ্ণবমতে৷ মল্লরাজ পরিবার বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর উপাধি নেন সিংহ দেব, পরে হয় সিংহ ঠাকুর৷
মা দুর্গাকে প্রতিদিন ফল মিষ্টির সঙ্গে অন্নভোগ দেওয়া হয়৷ আর রাতে দেওয়া হয় দুধ চুলি ভোগ৷ পুজোর ক’দিন গৃহদেবতা রাধাবিনোদকে মায়ের কাছে এনে ঠাকুরদালানে রাখা হয়৷ এই ক’দিন গৃহদেবতার সেবা চলে ঠাকুরদালানে৷ বিজয়া দশমীর দিন সকালে মাকে চ্যাং মাছের সঙ্গে পান্তাভাত দেওয়া হয়৷
এই বাড়ির দুর্গাপটকে বিসর্জন দেওয়া হয় না৷ দশমীর পুজোর পর নবপত্রিকাকে বিসর্জন দেওয়া হয়৷ বিজয়া দশমীর দিন এখানে রামচন্দ্রের পুজো হয়৷ মানকচু পাতা, কলাপাতা ও বেলপাতায় রামচন্দ্রের নাম লেখা হয়৷ সবশেষে সবাই মঠবাড়িতে যান, যেখানে তাঁদের পূর্বপুরুষের সমাধি রয়েছে, তাঁদেরকে প্রণাম জানিয়ে সমাপ্ত হয় কুচিয়াকোল মল্লরাজবাড়ির দুর্গাপুজো৷
কীভাবে যাবেন:
হাওড়া বা সাঁতরাগাছি স্টেশন থেকে ট্রেনে বিষ্ণুপুর৷ সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে চলুন কুচিয়াকোল৷ বিষ্ণুপুর থেকে কুচিয়াকোলের দূরত্ব ২০ কিমি মতো৷ বিষ্ণুপুরে থাকার জন্য সরকারি ও একাধিক বেসরকারি হোটেল রয়েছে৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.