দেবব্রত মণ্ডল, বারুইপুর: গৌরী, পার্বতী। কৈলাসে সবাই এমনই সব আদুরে নামে মেয়েটিকে ডাকেন। ফি বছর শরতে সে-ই নেমে আসে মর্ত্যলোকে, সকলের ঘরের ‘উমা’ হয়ে। কিন্তু ক্যানিংয়ের ভট্টাচার্য পরিবারের দুর্গাপ্রতিমা দেখলে আমাদের চেনা ‘গৌরী’র ছবি কেমন যেন ধাক্কা খায়। এখানে দুর্গা গৌরবর্ণা নন, কৃষ্ণবর্ণা। ক্যানিংয়ের (Canning) ভট্টাচার্য পরিবার এই কালো দুর্গার পুজোই (Durga Puja) করে আসছেন ২২০ বছর ধরে। শোনা গেল পুজোর ইতিহাসের কথা।
দক্ষিণ ২৪ পরগণা (South 24 Parganas) জেলার সুন্দরবনের ‘সিংহ দুয়ার’ নামে খ্যাত ব্রিটিশ আমলের ঐতিহ্যবাহী ক্যানিং মহকুমা শহরের দিঘিরপাড় গ্রাম পঞ্চায়েতের ১ নম্বর ভট্টাচার্য পরিবারের বাড়িটি। এই বাড়ির দেবী দুর্গা রাজ্য তথা দেশের মধ্যে ব্যতিক্রমী বলেই পরিচিত। অন্যান্য দুর্গা প্রতিমার মূর্তি যেখানে গৌরবর্ণের রং দিয়ে গড়া হয়ে থাকে, সেখানে এই ভট্টাচার্য বাড়ির শতাব্দী প্রাচীন দুর্গামূর্তির মুখের রঙ কালো। কৃষ্ণবর্ণ প্রতিমাকেই বংশ পরম্পরায় পুজো করে আসছেন পরিবারের বংশধররা।
কিন্তু কেন ভট্টাচার্য পরিবারের দেবী দুর্গার এই ভিন্ন রূপ? তা জানতে পিছিয়ে যেতে হয় প্রায় ২২০ বছর আগে। এই ভট্টাচার্য পরিবার একসময় বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের পাইনখাড়া গ্রামে বসবাস করতেন। সেই বংশের কালীপ্রসন্ন, কাশীকান্ত, রামকান্ত, রামরাজা ভট্টাচার্যরা মিলিতভাবেই সর্বপ্রথম বাংলাদেশের ঢাকা বিক্রমপুরের পাইনখাড়া গ্রামেই দুর্গা পুজো শুরু করেন। তা আজ থেকে প্রায় ৪৩৫ বছর আগে অর্থাৎ ১৫৮৫ সালে। তৎকালীন সময়ে জাঁকজমক করে সেই পুজো করা হতো। আবার দেশভাগের পর এই ক্যানিং শহরে ভট্টাচার্য পরিবার চলে আসেন ১৯৩৮ সালে। ক্যানিংয়ে চলে এলেও পুজোর সময় ক্যানিং থেকে সপরিবারে বাংলাদেশের বিক্রমপুরের পাইনখাড়া গ্রামে গিয়ে পুজো করে আসতেন সদস্যরা। ক্যানিংয়ের পুজো অবশ্য ৭৪ তম বর্ষে পড়ল।
ক্যানিংয়ে সর্বপ্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন ভট্টাচার্য্য পরিবারের সদস্য ইন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য। প্রতিমার রঙ কালো কেন, সেই প্রসঙ্গে বর্তমান পরিবারের সদস্য পীযুষকান্তি ভট্টাচার্য বলেন, ”প্রায় ২০০ বছর আগে বাংলাদেশেই দুর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন পাশের মনসা মন্দিরের জ্বলন্ত প্রদীপের শিখা থেকে কোনও প্রকারে একটি কাক জ্বলন্ত সলতে নিয়ে মণ্ডপের উপর বসে। সেই সলতের আগুনে লেগে যায় সোনা দিয়ে তৈরি দুর্গামণ্ডপের চালা ঘরে। আর মুহূর্তের মধ্যেই সেই বিধ্বংসী অগ্নিশিখার লেলিহান আগুন গ্রাস করে নেয় সমগ্র পুজো মণ্ডপকে। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রক্ষা পায়নি স্বয়ং দেবী দুর্গাপ্রতিমার মূর্তিও। এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় ভেঙে পড়ে সমগ্র ভট্টাচার্য পরিবারের সকলে। অনেক সাধারণ মানুষজন সেই সময় তাঁদের বলেন, মা দুর্গা তাঁদের উপর রুষ্ট হয়েছেন।
এই কথা শোনার পর ভট্ট্যাচার্য পরিবারের এক সদস্য মায়ের পোড়া মূর্তির সামনে ধ্যানে বসেন। তিনি জানতে পারেন, পুজো হবে। তবে পুড়ে গিয়ে মুখ যেমন কালো শরীর, বাদামী রং হয়েছে ঠিক তেমনভাবে মূর্তি গড়ে পুজো করা যাবে। সেই থেকেই প্রতিমার মুখ কালো এবং শরীর বাদামী রঙের হয়ে আসছে। পুজোর শুরুতেই মোষ বলির প্রচলন ছিল। কিন্তু মোষ বলি দেওয়ার জন্য সেই সময় কেউ মায়ের প্রসাদ খেতেন না বলেই পরবর্তীকালে পাঁঠা বলি দেওয়া শুরু হয়। আবার পাঁঠা বলি দেওয়ার জন্য মা স্বপ্নাদেশ দিয়ে জানায় “শান্তির জন্য পুজো করে বলি?এটা বন্ধ করতে হবে।বন্ধ না হলে ভট্টাচার্য পরিবারের বংশ একেবারেই ধ্বংস করে দেব।” এই স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর প্রায় ৬৪ বছর আগে পাঁঠা বলি দিতে গিয়ে,বলি দেওয়ার খড়গ্ আটকে যায়।ফলে সেই সময় বলি দেওয়া একপ্রকার ব্যাঘাত ঘটে।তারপর সেই থেকেই বলি দেওয়া প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য মায়ের আদেশ অনুযায়ী সপ্তমী,অষ্টমী ও সন্ধী পুজোয় চালকুমড়ো বলি এবং নবমীতে চালকুমড়ো,শশা,ও শত্রু বলি দেওয়ার প্রচলন শুরু হয় সেই থেকেই।
এছাড়াও আরও একটি বিশষ বৈশিষ্ট রয়েছে। যেখানে অন্যান্য মণ্ডপে দেবী দুর্গার ডানদিকে লক্ষ্মী-গণেশ থাকে, সেখানে ভট্টাচার্য বাড়ির প্রতিমার বাঁ দিকে গণেশ ও সরস্বতী রয়েছে। এছাড়াও যথারীতি নিয়মনিষ্ঠা মেনেই দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন করে থাকেন। বিসর্জনের পর প্রতিমা জলের তলায় তিনদিন পুঁতে রাখা হয়, যাতে প্রতিমা গভীর জল থেকে উপর ভেসে না ওঠে। এরপর সেই কাঠামো তোলা হয় লক্ষ্মী পুজোর পরের দিন। আবার আগামী বছরের জন্য প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয় জন্মাষ্টমীর পূণ্যতিথি থেকেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.