ছবি: অমিতলাল সিং দেও।
সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: মুখ নিচু। হাত চলছে। জরি, আয়নার টুকরো, টিকলি দিয়ে মা উমার ডাকের সাজ তৈরি করছেন তাঁরা। সেই ডাকের সাজ হস্তশিল্পের দোকানে বিক্রিবাটা করলে তবেই ছেলেমেয়েদের নতুন জামাকাপড় কিনে দিতে পারবেন ওই শিল্পীরা। কিন্তু সেসব বিক্রি হবে, তবে তো? করোনা কালে (Coronavirus) যে সেভাবে বরাতই নেই। বিশ্বকর্মা পুজো আসতে চলল, কিন্তু দুর্গাপুজোয় (Durga Puja) আগের মতো অর্ডারের পর অর্ডার কই? ফলে মা দুগ্গাকে ডাকের সাজে সাজিয়ে ছ’মাসের রোজগার ঘরে তুলে রাখা তো দূর অস্ত, পুজোয় পরিবারের সবাইকে নতুন জামাকাপড় দিতে পারবেন কিনা, সেই চিন্তাতেই দিন কাটছে দিলীপ যোগী, শ্রীরাম যোগী, স্বপন যোগীদের।
পুরুলিয়ার (Purulia) আড়শা ব্লকের বেলডি গ্রাম পঞ্চায়েতের বামুনডিহা গ্রামের যোগীপাড়া। মা দুর্গার ডাকের সাজের জন্য যার খ্যাতি শুধু এই জেলাতেই নয়, বামুনডিহাকে চেনে আশেপাশের জেলা-সহ লাগোয়া ঝাড়খণ্ডও। তাই মায়ের আগমনে এই বামুনডিহার যোগীপাড়ার চেহারাই বদলে যায়। সারাদিন, এমনকী রাতেও কর্মচঞ্চল এই পাড়া। বরাতের জোয়ার আসে। পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই শুধু নয়, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করে ক্রেতার হাতে তা তুলে দিতে ঘরের মহিলা, এমনকী ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও পর্যন্ত হাত লাগাতে হয়।
কিন্তু এ বছর কোথায় কী? সেসব ব্যস্ততার ছবি আজ অতীত। কোভিডের (COVID-19) ছোবলে সব যেন হারিয়ে গিয়েছে। পুজো কমিটিগুলো এই শিল্পীদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগই করেনি এখনও। আসলে, তাদের পুজোর বাজেটই যে কাটছাঁট হয়েছে। তাই হস্তশিল্পীদের দোকান থেকেই এসব সামগ্রী নিয়ে কোনওভাবে প্রতিমার সাজসজ্জা সারবেন। করোনা আবহে গত বছর থেকে এমনটাই রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে।
মূলত ডাকের সাজ সাবেকি প্রতিমাতেই ব্যবহার হয়ে থাকে। আর কয়েকটি ক্ষেত্রে হস্তশিল্পীদের দোকানের মালিকরা এই ডাক শিল্পীদের বরাত দিলেও তার মূল্য অনেকটাই কম। অথচ ডাকের শিল্পকলা দিয়ে মাকে সাজাতে যে সব সামগ্রী তৈরি হয়, তার দামও এখন আকাশছোঁয়া। যেমন, এই কাজে পুরনো খবরের কাগজের দাম এখন কেজি প্রতি ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। সেই সঙ্গে জরি, আয়নার টুকরো, থার্মোকল, রঙিন কাগজ তো রয়েইছে।
এসব নিয়ে কাজ করতে করতেই দিলীপ যোগী বলেন, “আমাদের এই শিল্পকলার ভবিষ্যৎ আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। এই করোনা আমাদের সব শেষ করে দিল। গত বছর থেকে তো সেই আগের মত বরাত পাচ্ছি না। তবে এবার গতবারের তুলনায় একটু ভালো। কিন্তু গতবারের ধাক্কা এখনও সামলে উঠতে পারিনি। আশা করেছিলাম, এবার হয়ত স্বাভাবিক হবে। কিন্তু যেভাবে তৃতীয় ঢেউয়ের ভ্রুকুটি আছে তাতে পুজো কমিটিগুলি বাজেটে কাটছাঁট করেছে। ফলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগই করছে না কেউ। তাই পুরুলিয়া শহরের হস্তশিল্পের দোকানগুলোতে বিক্রি করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।”
উৎসবের দিনে বামুনডিহার যোগীপাড়ার পরিবারগুলোর এমন করুণ মুখ দেখে হা-হুতাশ করছেন এই শিল্পীদের কাঁচামাল সরবরাহ করা ব্যবসায়ীরা। আসলে এই সমস্ত কাজই তো একটা শৃঙ্খলে বাঁধা। ফলে সেই শৃঙ্খলের একটা অংশে প্রভাব পড়লে বাকি অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। ডাকের সাজের কাজ করা রেখা যোগী, সরলা যোগীরা বলছিলেন, “গতবার পরিবারের সকলের দুর্গাপূজার নতুন জামাকাপড় হয়নি। এবারও করতে পারব কিনা বুঝতে পারছি না। তবে ছেলেমেয়েদের সবার হয়ে গেলে বাঁচি। আমরা না হয় মা দুগ্গা দুগ্গা করে পুরনো কাপড়েই অঞ্জলি দেব।” হতাশা ঝরে পড়ে যোগী পাড়ায়। বছরে একবারই মা আসেন। কিন্তু তবুও উৎসবের আনন্দ নেই জঙ্গলমহলের এই মহল্লায়। বরাত কম থাকায় পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়েছে যে যোগী পাড়ায় এই শিল্পকর্মের সঙ্গে প্রায় ২০টি পরিবার যুক্ত থাকলেও নিজেদের পেশা ছেড়ে এবার মাত্র সাত-আটটি পরিবার এই কাজ করছেন। তাই মা উমার কাছে যোগীপাড়ার প্রার্থনা, উৎসবের আনন্দ ফিরিয়ে দাও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.