সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: কোভিডের থাবাতেও আগমনী গান, বলি, আরতি-সহ গুপ্তাতিগুপ্ত ‘শ্রীনাদ’ মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে পঞ্চকোট রাজপরিবারে শুরু হয়ে গিয়েছে দুর্গাপুজো। আগামী আশ্বিন মল মাস হওয়ায় এবার ৪৬ দিন ধরে পুজো হবে পঞ্চকোটের রাজরাজেশ্বরীর ঠাকুর দালানে। বিগত দুই শতাব্দীতে যা দেখেনি তামাম পঞ্চকোট (Panchakot)।
জিতাষ্টমীর পরের দিন আর্দ্রা নক্ষত্রযুক্ত কৃষ্ণপক্ষের নবমীর দিন অর্থাৎ গত শুক্রবার তন্ত্র বিরাচার মতে গোপন মন্ত্রে মা শিখরবাসিনীর দুর্গা পুজো (Durga Puja 2020) শুরু হয় পঞ্চকোটের কাশীপুরের দেবীবাড়িতে। ফলে এই অতিমারীতেও থমকাল না দু’হাজার বছরের প্রাচীন এই পুজো। বরং অতীতের সমস্ত রীতি-নীতি মেনে মহালয়ার ছ’দিন আগেই ‘বোধন’-এর মাধ্যমে পুজোর ঢাকে কাঠি পড়েছে। তবে সঙ্গী সেই মাস্ক, স্যানিটাইজার ও সামাজিক দূরত্ব! মা শিখরবাসিনী দুর্গা এখানে অষ্টধাতুর তৈরি। চতুর্ভুজা, পদ্মফুলের উপর বসে থাকা রাজরাজেশ্বরী মূর্তির দুর্গা ষোলো দিন ধরে পুজো পায়। তাই ষোলো কল্পের পুজো বলে। কিন্তু এবার পুজো হবে টানা ৪৬ দিন। কৃষ্ণপক্ষের নবমী থেকে মহালয়া পর্যন্ত সাতদিন। সেই সঙ্গে প্রতিপদ থেকে মহানবমী পর্যন্ত ন’দিন ষোলোকল্পের পুজো হবে ষোড়শ প্রচার ও বিরাচারে। তবে বাকি ৩০ দিন ঘটের মধ্যে আবাহিত দেবী দুর্গাকে পঞ্চ প্রচারে পুজো করা হবে।
বর্তমানে এই রাজপরিবারের কূলদেবীমাতা রাজরাজেশ্বরীর আলয়ে এই পুজো হয়। সেখানেই কথা হচ্ছিল পঞ্চকোট রাজবংশের বংশধর তথা সিপাহী বিদ্রোহীর মূল উদ্যোক্তা মহারাজাধিরাজ নীলমণি সিং দেওর প্রপৌত্র সৌমেশ্বরলাল সিং দেওর সঙ্গে। তাঁর কথায়, “এই পুজো নিয়ে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে অনেক কথাই শুনেছি। কিন্তু ৪৬ দিন ধরে পুজোর কথা আগে কখনও শুনিনি। এবার আশ্বিন মল মাস হওয়ায় ঠাকুরদালানের দেবীবাড়িতে ৪৬ দিন ধরে দুর্গা পুজো হবে।”
এই পুজোর পরতে-পরতে জড়িয়ে ইতিহাস। নানা পৌরানিক আখ্যান। মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীর ধার নগরের মহারাজা বিক্রমাদিত্যের বংশধর জগদ্দেও সিং দেওর কনিষ্ঠ পুত্র দামোদর শেখর সিং দেও বাহাদুর চাকলা পঞ্চকোটরাজের প্রতিষ্ঠাতা। এই রাজস্থাপনের সময় থেকেই তাঁর পূর্বপুরুষ কুলপ্রথা অনুযায়ী শকাব্দ ২ থেকে শুরু হয়। রাবণবধ করার জন্য শ্রী রামচন্দ্র দেবী দুর্গার আরাধনার সূচনার্থে যে বোধন করেছিলেন, তা ‘অকালবোধন’ নামে পরিচিত। সেই মত অনুসারেই ধারনগরের প্রথা এবং কুলাচারকে মেনে মহারাজা দামোদরশেখর সিং দেও বাহাদুর এই জঙ্গলমহলে দুর্গা পুজো শুরু করেন। দামোদরশেখরের নামানুসারে এই বিস্তীর্ণ জঙ্গলমহলের নাম ‘শেখরভূম’ বা ‘শিখরভূম’ নামকরণ হয়। তাই এই দুর্গার নামও হয় শিখরবাসিনী দুর্গা।
এই রাজবংশের রাজধানী গড়পঞ্চকোট থেকে শুরু করে পাড়া, কেশরগড়, কাশীপুর যেখানে রাজত্ব স্থানান্তরিত হয়েছে সেখানেই এই পুজো চলছে। যে বনমালী পণ্ডিতের হাত ধরে এই পুজো হয়। তাদেরই বংশধর বর্তমানে গৌতম চক্রবর্তী এই পুজো করে থাকেন। রাজপরিবারের সদস্যরা বলেন, রাজরাজেশ্বরী দেবীই হলেন কল্যানেশ্বরী দেবীর প্রতিমূর্তি। যিনি মাইথনের কাছে সবনপুরে প্রতিষ্ঠিত। মহাঅষ্টমীর সন্ধিক্ষনে এই শিখরভূমে মা দুর্গার পায়ের ছাপ দেখা যায়। তাই তো কথিত আছে, “মল্লে রা শিখরে পা/ সাক্ষাৎ দেখবি তো শান্তিপুরে যা….”। সেই শিখরভূমের ঠাকুরদালানে ভেসে আসছে আগমনী সুর, “আজকে পেলাম তোমায় উমা/ মনের মাঝে রাখতে চাই/ আঁধার ভবন করলে আলো….।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.