অর্ণব দাস, বারাসত: কথায় বলে – ড্রাগের (Drug) নেশা সর্বনাশা। কার্যত নিজেদের জীবন দিয়ে তার প্রমাণ পেয়েছেন খড়দহের মনোজ দাস এবং বারাসতের চন্দন পালচৌধুরী। বইয়ের প্রবাদের সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে তাঁদের বিধিলিপি। নেশার ঝোঁকে উঠে গিয়েছিল ব্যবসা। নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে জেলযাত্রা, পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন, বাবার আত্মহনন – কী না দেখতে হয়েছে তাঁদের? কিন্তু যার শেষ ভাল, তার সব ভাল। নেশা এই দু’জনের জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিলেও কেড়ে নিতে পারেনি বাঁচার খিদে, জীবনীশক্তিকে। বেঁচে থাকার সেই অদম্য ইচ্ছাশক্তিতেই ভর করে আজ তাঁরা মাদকবিরোধী আন্দোলনের (Anti drug campaign) অন্যতম মুখ। নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তাঁরা যুবসমাজকে পথে নেমেছেন বোঝাতে যে ড্রাগের নেশা সত্যিই কতটা সর্বনাশা।
খড়দহের (Khardah) পূর্ব কল্যাণনগর মাঠপাড়ার বাসিন্দা মনোজ দাস। বাড়িতে মা, বাবা, দিদা, ভাই, স্ত্রী এবং দুই ছেলে রয়েছে। সংসার চালাতে প্রথমে তিনি একটি চায়ের দোকান করেন। পরে চায়ের দোকানের সঙ্গে জুড়ে দেন সিডি-ক্যাসেটের ব্যবসা। ঠিকঠাকই চলছিল সংসার। কিন্তু বাড়তি রোজগারের আশায় অপরাধ জগতের ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। তার থেকেই ২০১১ সালে ৩১ বছর বয়সে তিনি হেরোইনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। নেশার টাকা জোগাড় করতে প্রথমে বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা। এরপর টাকা জোগাড় করতে তিনিও নেশার সামগ্রী বিক্রি শুরু করেন।
এসবের জেরে ২০১৪ সালে প্রথম জেলে যান। জেল থেকে বেরিয়ে ফের নেশা। ২০১৮ সাল পর্যন্ত একাধিকবার জেলে গিয়েছেন। ততদিনে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে তাঁর। তবুও নেশার প্রতি প্রেম কমাতে পারেননি। কিন্তু শেষবার জেলে গিয়ে এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁর সঙ্গে মিশেই ভুল বুঝতে শুরু করেন মনোজ এবং জেলে বসেই স্থির করেন আর নেশা করবেন না। সাড়ে তিন বছর পর ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে সত্যিই তিনি আর নেশা করেননি। তবে পরিবারের ফিরতে পারেননি। তাই বারাসতে (Barasat) এসে শুরু করেন নেশামুক্তির সচেতনতা প্রচারের কাজ। মনোজ দাস বলেন, ‘‘পরিবারের লোক এখনও আমাকে মেনে নিতে পারেনি। আমিও পরিবারে ফিরতে পারিনি। তাই ঠিক করেছি আমার মতো কোনও যুবক যেন বিপথগামী না হয়। সেই কারণেই নেশামুক্তি ক্যাম্পেনের কাজ করছি।’’
অন্যদিকে, বারাসতের নেতাজিপল্লির বাসিন্দা চন্দন পালচৌধুরী। মা-বাবাকে নিয়ে ছিল সুখের সংসার। বাবা ছিলেন ঠিকাদারি কাজের কন্ট্রাক্টর। নিজেও শুরু করেছিলেন জলের পাইপলাইনের কাজ। কিন্তু মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ড্রাগের নেশায়। নিজের রোজগার তো নেশার জন্য খরচ হতই, উল্টে বাড়ি থেকেও নানা অছিলায় টাকা নিতে শুরু করেন নেশার জন্য। ২০১৮ সালে মা-বাবা তাঁকে বিয়ে দেন। ভেবেছিলেন, বিয়ে করলে হয়তো ছেলে সঠিক পথে ফিরবে। কিন্তু তা তো হলই না, উল্টে অশান্তি বেড়ে বিয়ের আট মাসের মাথায় স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। পারিবারিক অশান্তি তখন চরমে পৌঁছয়। অবশেষে আত্মঘাতী হন চন্দনের বাবা। অবসাদে নেশা করার প্রবণতা বেড়ে যায় তাঁর। মা শারীরিক অসুস্থতায় একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। একই সঙ্গে তিনি কাজও হারান।
এত কিছুর পর নিজের ভুল বুঝতে পেরেও নেশা ছাড়তে পারছিলেন না চন্দন। অবশেষে, বারাসত ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে ন’পাড়া কালীবাড়ির কাছে একটি নেশামুক্তি কেন্দ্রে ভরতি হন ২০২২ সাল। চিকিৎসা নিয়ে এখন পুরোপুরি নেশামুক্ত তিনি। ছেলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরায় মা এখন অনেকটাই সুস্থ। ৩১ বছর বয়সে তিনি এখন বেছে নিয়েছেন নেশামুক্তি সচেতনতা প্রচারের কাজ। চন্দন বলেন, ‘‘ড্রাগের নেশার জন্য সর্বস্বান্ত হয়েছি, বাবাকে হারিয়েছি। তাই যুবসমাজ নেশাগ্রস্ত হোক – এটা চাই না। এই কারণেই সচেতনতা প্রচারের কাজ করছি।’’
নেশার কারণে এমনই বিপথগামী যুবকদের দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে সমাজের মূলস্রোতের ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন দীপন মজুমদার। তিনি বলেন, ‘‘দীর্ঘ বছর ধরে চেষ্টা করেছি নেশাগ্রস্ত যুবকদের সঠিক পথে ফেরানোর। অধিকাংশই স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। একইসঙ্গে সচেতনতার প্রচারটা দরকার যাতে নতুন প্রজন্ম নেশার সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে। সেই কাজটাই করছি।’’ রবিবার বিশ্ব মাদকবিরোধী দিবস। তার আগে চন্দন, মনোজদের মতো যুবকরাই দীপনদের পাশে দাঁড়িয়ে সমাজকে নেশামুক্তির পথে আরও একধাপ এগিয়ে দেবে, সেটাই আশা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.