বিপ্লব দত্ত, কৃষ্ণনগর: নানারকম আলোকসজ্জা, বিভিন্ন রকম বাজনা সহযোগে শনিবার সন্ধ্যের পর গৌরাঙ্গ মহাপ্রভূকে নিয়ে নবদ্বীপ শহর পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে শেষ হল ঐতিহ্যবাহী দোল উৎসব। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তাঁকে নিয়ে বৈষ্ণব ভক্তরা খেললেন আবির। সঙ্গে নগরসংকীর্তন। এই উৎসবের নাম চোদ্দ মাদল উৎসব।
প্রাণের এই উৎসবে যোগ দিয়েছিলে হাজার হাজার বৈষ্ণবধর্মের মানুষ। আলোকসজ্জায় সজ্জিত এই চোদ্দ মাদল উৎসব দেখার মত। চৈতন্য মহাপ্রভূর আবির্ভাব তিথি বা কৃষ্ণের দোল উৎসবের পরদিন ‘জগন্নাথ উৎসবে’ মেতে ছিলেন নবদ্বীপধামে আসা অসংখ্য ভক্ত। তবে নাম দেখে পুরীর জগন্নাথদেবকে ঘিরে কোন উৎসব ভাবলে ভূল ভাবা হবে। নবদ্বীপধামে দোল উৎসবের কেন্দ্রে থাকেন সেই চৈতন্য মহাপ্রভূকে। তাঁকে আপামর বৈষ্ণবসমাজ ‘সচল জগন্নাথ’ বলে অভিহিত করেন। আসলে রাধাকৃষ্ণের দোল সারা ভারতে বসন্তের উদযাপন বলে স্মরণাতীত কাল থেকে মান্যতা পেয়ে আসছে। ব্যতিক্রম শুধু নবদ্বীপধাম। অন্যান্য জায়গায় কৃষ্ণের দোলযাত্রা উৎসব হলেও চৈতন্যধামে তা শুধুই মহাপ্রভুর জন্মতিথি উৎসব। যে মহাপ্রভূ পরবর্তীকালে শ্রীকৃষ্ণের স্মরণে যমুনা পাড়ের উৎসবকে টেনে এনেছিলেন গঙ্গার পাড়ে। তাই মহাপ্রভূর আবির্ভাব তিথিতে জগন্নাথ উৎসব সেই ধারাবাহিকতার ফল।
[ আরও পড়ুন: হোলির দিনের অশান্তি গড়াল রাজনৈতিক সংঘর্ষে, বনগাঁয় গ্রেপ্তার বিজেপি নেতা ]
নবদ্বীপে দোলের উৎসব একেবারেই ছকভাঙা এক মায়াময় উৎসব। ইতিহাস বলে, ১৪৮৬ সালের দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় জন্ম নিয়েছিলেন গোরাচাঁদ। সেই স্মৃতিকে স্মরণে রাখতে বৈষ্ণবসমাজ দোল পূর্ণিমাকে বদলে দেন গৌরপূর্ণিমায়। চৈতন্যজন্মের প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর পরেও চৈতন্যভূমিতে দোলের দিন তাই শুধুই মহাপ্রভুর আবির্ভাবতিথি উৎসব। শ্রীধাম মহাপ্রভুর মন্দিরে, চৈতন্য জন্মস্থানে এদিন আবির বা কুমকুম নয়, প্রস্তুত থাকে সুগন্ধি অভিষেক বারি, পঞ্চামৃত। দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় আকাশে চাঁদ উঠলেই মায়েদের মুখে বেজে ওঠে শতাধিক শঙ্খধ্বনি, কাঁসর ঘণ্টা, মৃদঙ্গ ও মন্দিরা। এরপর শুরু হয়ে যায় মহাভিষেক। চৈতন্য বিগ্রহের প্রতীক হিসেবে জগন্নাথ মিশ্রের গৃহেপূজিত ‘রাজরাজেশ্বর’ শিলাকে ১০৮ ঘড়া জলে মহাস্নান করানোর পর ষোড়শোপচারে হয় অভিষেক ও নানবিধ কাজ।
প্রতিদিন যিনি দেবতা, কেবল একদিনই তিনি প্রিয়। সারা বছর তিনি আপামর ভক্তের ধামেশ্বর গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, রাধাকৃষ্ণের মিলিত তনুশ্রীচৈতন্য। কিন্তু ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিনে তিনি সে সব কিছুই নন। জগন্নাথ মিশ্রের পত্নী শচীদেবীর কোল আলো করা সদ্যজাত শিশু নিমাই। পরনে লাল চেলি, হাতে চুষিকাঠি। চারপাশে ছড়ানো ঝিনুক-বাটি, ঝুমঝুমি। ভক্তিতে নয়, সেদিন অপত্য স্নেহে সিক্ত তিনি। দোলের পরদিন অন্নপ্রাশন। নবদ্বীপের মহাপ্রভূ মন্দিরের দক্ষিণদুয়ারি সিংহদরজার উপর নহবতখানায় সানাইয়ের সুরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে নাটমন্দিরের পদাবলী কীর্তন। লালচেলিতে শিশু সাজে ধামেশ্বর মহাপ্রভূর দুর্লভ দর্শনে আসা হাজার হাজার ভক্ত গর্ভগৃহের সামনে জড়ো হন। হাতে তাঁদের থাকে ফুলমালার বদলে শিশুর খেলনা, বেলুন।
মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশন উৎসবেরই অপর নাম জগন্নাথ উৎসব। ধামেস্বর মহাপ্রভুর সেবায়েত গোস্বামীরা জানিয়েছেন, তাঁরা ছাড়া আর কেউ মহাপ্রভূকে অন্নপ্রাশন দেওয়ার অধিকারী নন। নবদ্বীপের এই মন্দিরেই বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী সেবিত মহাপ্রভুর শ্রীবিগ্রহের সেবা, পুজো হয়ে আসছে। বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর উত্তরাধিকার পুরুষানুক্রমে বহন করে চলেছেন তাঁর ভাইয়ের বংশের উত্তরপুরুষেরা। সেই গোস্বামীরা এই উৎসব পালন করে আসছেন। তবে বহু প্রাচীন এই অন্নপ্রাশন উৎসবের শুরু ঠিক কবে থেকে, তা নিয়ে কোন পাথুরে প্রমাণ নেই। সেবাইতদের তরফে সুদীন গোস্বামী, জয়ন্ত গোস্বামীরা জানিয়েছেন, শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পর নন্দরাজ যে ভাবে উৎসব করে ছিলেন, নিমাইয়ের জন্মের পর জগন্নাথ মিশ্রও একই ভাবে উৎসব করেছিলেন। তাই এই অন্নপ্রাশন উৎসবের আর এক নাম ‘জগন্নাথ উৎসব’।
এদিন সকাল থেকেই মহাপ্রভুর নামকরণ, চূড়াকরণ সবই হয়ে থাকে। তবে সবটাই প্রতীকী ভাবে। নিমাই অর্থাৎ মহাপ্রভুর দাদামশাই নাম রেখেছিলেন বিশ্বম্ভর। এদিন প্রতীকী নামকরণ করা হয়। তারপর ভোগ নিবেদন। এ দিন মহাপ্রভুকে অন্নব্যঞ্জন পরিবেশন করা হয় মহামূল্য পাত্রে। রূপো, তামা, কাঁসা এবং পেতল এই চার ধরনের পাত্রে সাজানো হয় পদগুলি। রূপোর থালা,বাটি, রেকাবিতে দেওয়া হয় অন্নব্যঞ্জন। হাত ধোয়ার গাড়ূ, পানের ডাবর সবই রূপোর। সাদা পর্দা ঘেরা নাটমন্দিরের প্রশস্ত চত্বরে সাজানো ছাপ্পান্ন ভোগ। নামে ছাপ্পান্ন ভোগ হলেও অন্ন,পরমান্ন, পুষ্পান্ন,মিষ্টান্ন, তরকারি, ভাজা, পুরি, নিমকি,চাটনি সব মিলিয়ে পদের সংখ্যা দাঁড়ায় কয়েকশো। মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশনের মেনুতে থাকে হাজারও রকমের পদ তরকারি, ডাল, শুক্তো, ভাজা, পোস্ত, শাক এবং চাটনি থাকে সাত রকমের। সঙ্গে মহাপ্রভূর প্রিয় থোড়, মোচা, কচুর শাক, বেগুনপাতুরী, ছানার রসা (ডালনা), ধোকার ডালনা, লাউ, চালকুমড়ো থাকবেই। পোস্ত দিয়ে যত রকমের পদ সম্ভব। এমনকী ছানার পোস্ত, কুল, তেঁতুল, আম, আমড়ার টকও থাকে। সব শেষে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ধামেশ্বর মহাপ্রভূর মন্দিরের চাতালে বসে হাজারও ভক্ত অন্নপ্রাশনের মহাপ্রসাদ পেলেন। শনিবারে চোদ্দ মাদল উৎসবকে ঘিরে মানুষের উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মত।
[ আরও পড়ুন: সোনা-সহ স্ত্রীর ধরা পড়ার খবর সম্পূর্ণ ভুয়ো, দাবি অভিষেকের ]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.