ছবি: সুনীতা সিং।
সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: কান থেকে প্রায় দেড় ইঞ্চি উপরে খুলির হাড়ে আটদিন ধরে গেঁথে ছিল বুলেট (Bullet)! ফলে খুলির ভাঙা হাড় মস্তিষ্কে ক্ষত তৈরি করে। হয়ে গিয়েছিল সংক্রমণও। জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাঁকুড়ার গুলিবিদ্ধ যুবকের মাথার খুলি থেকে ওই বুলেট বার করে রীতিমতো অসাধ্য সাধন করল পুরুলিয়া (Purulia) দেবেন মাহাতো গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। স্বল্প পরিকাঠামোয় এমন সফল জটিল অস্ত্রোপচারে ওই স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক দলকে বাহবা জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যাকে বড়সড় সাফল্য হিসাবেই দেখছে দেবেন মাহাতো গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। এই হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপারিনটেনডেন্ট কাম ভাইস প্রিন্সিপাল প্রফেসর সুকোমল বিষয়ী জানান, “এই অস্ত্রোপচার সত্যিই জটিল ছিল। আমাদের মেডিক্যালের চিকিৎসকরা দারুন কাজ করেছেন।”
গত বুধবার দুপুর একটার পর থেকে এক ঘন্টা ধরে দুটো পর্যন্ত এই অপারেশন চলে দেবেন মাহাতো গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের শল্য চিকিৎসক (Surgeon) পবন মণ্ডলের তত্ত্বাবধানে। মোট পাঁচ চিকিৎসককে নিয়ে গঠিত ওই দলে থাকা বাকি চার চিকিৎসক হলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসার সোমনাথ বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল হালদার, সিদ্ধেশ্বর কিসকু ও সাগুন সরেন। সেই সঙ্গে সেবিকা শ্বেতা দাস কর্মকার। এছাড়া এনাস্থেসিয়া দলে চিকিৎসক অজিতপ্রসাদ মুর্মুর নেতৃত্বে আরও দুই চিকিৎসক। এই অস্ত্রোপচার (Operation) একেবারে সহজ ছিল না, তা বলছেন চিকিৎসকরা।
বাঁকুড়ার (Bankura)গঙ্গাজলঘাটি থানার পাবড়াডিহি গ্রামের বাসিন্দা ৩৮ বছরের গোবিন্দ মন্ডলের ওই বুলেটটি ‘অক্সিবিটো টেম্পোরাল বোন’ নামে খুলির হাড়ে গেঁথেছিল। এই ধরনের আঘাত থেকে ক্ষতকে ‘ডিপ্রেসড স্কাল বোন ফ্র্যাকচার’ বলে। এই ধরণের অবস্থায় রোগী কোমাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া গুলিবিদ্ধ হওয়ার আট দিন পর এই অস্ত্রোপচার হয়। গত ৫ সেপ্টেম্বর খুনের মামলায় জামিন পাওয়ার পর একজনের গাড়িতে চেপে যাওয়ার সময় এই যুবক দুপুর দেড়টা নাগাদ বাঁকুড়া শহরের কেশিয়াকুল এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। গাড়ির কাঁচ ভেদ করে তার মাথায় গুলি লাগে। ওই সফল অস্ত্রোপচারের পর বুধবার রাতেই ওই গুলিটি সংগ্রহ করে বাঁকুড়া জেলা পুলিশ। যেহেতু এই ঘটনার তদন্ত চলছে বাঁকুড়ায়। বাঁকুড়া জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, তারা যে গুলিটি বাজেয়াপ্ত করে তার দৈর্ঘ্য আনুমানিক ১ সেন্টিমিটার। যা পিতলের তৈরি।
চলতি মাসের ৫ তারিখ ওই ঘটনার পর গুলিবিদ্ধ গোবিন্দ মণ্ডলকে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি তিন দিন ছিলেন। তারপর তাকে গত ৯ সেপ্টেম্বর দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখানে চিকিৎসার খরচ শুনে মাথায় হাত হয় ওই দরিদ্র পরিবারের। ফলে দুর্গাপুরে আরও একটি বেসরকারি হাসপাতালে যান তারা। রোগীর পরিস্থিতি জটিল থাকায় তাকে রেফার করে দেয় ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ । তখন গুলিবিদ্ধ ওই যুবকের পরিবার দিশাহারা হয়ে বাড়ি চলে আসে। তারপর বাড়ির কাছে বাঁকুড়ার অমরকানন গ্রামীণ হাসপাতালে ১০ ই সেপ্টেম্বর ভর্তি করে। রোগীর ওই জটিল পরিস্থিতি দেখে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক দেবশঙ্কর হাঁসদা দেবেন মাহাতো গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের শল্য চিকিৎসক পবন মণ্ডলকে বিষয়টি ফোন করে জানান।
এরপর ১২ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ মঙ্গলবার ওই গুলিবিদ্ধ যুবক দেবেন মাহাতো গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের হাতোয়াড়া ক্যাম্পাসের বহির্বিভাগে আসেন। বহির্বিভাগ থেকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করে নেওয়া হয়। অপারেশনের জন্য পরিকল্পনা শুরু করেন চিকিৎসকরা। বুধবার ১৩ই সেপ্টেম্বর হয় অস্ত্রোপচার। এখন ওই যুবক একেবারে স্থিতিশীল। অপারেশনের নেতৃত্ব দেওয়া শল্য চিকিৎসক পবন মণ্ডল বলেন, “মাথার খুলির মধ্যে আর বুলেটের কোন অংশ নেই। একশ শতাংশ বের করে দেওয়া হয়েছে । এই ধরনের ক্ষতকে ‘ডিপ্রেস্ড ফ্র্যাকচার স্কাল বোন’ বলে। ওই রোগী এখন স্থিতিশীল। তবুও আমরা তাকে পর্যবেক্ষণে রেখেছি। শুক্রবার ড্রেসিং হয়েছে। ওই রোগীর সংক্রমণ হয়ে যাওয়াই বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। ফলে এই কাজ সহজ ছিল না। ” বর্তমানে ওই রোগী দেবেন মাহাতো গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের হাতোয়াড়া ক্যাম্পাসের ছ’ তলায় মেল ওয়ার্ডে রয়েছেন। তাঁর বাবা অমর মণ্ডল বলেন, “দেবেন মাহাতো মেডিক্যালের চিকিৎসকরা ভগবান। আমার ছেলের জীবন বাঁচিয়েছেন। ঘটনার পর থেকে এক সময় খুব অসহায় লাগছিল। কী করব ভেবে উঠতে পারছিলাম না।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.