সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: সারপ্রাইজ ভিজিটে গিয়ে হাসপাতালের বেনিয়ম হাতেনাতে ধরলেন পুরুলিয়ার জেলাশাসক রাহুল মজুমদার। সপ্তাহের প্রথম দিন, সোমবার জেলাশাসক দুপুর একটা নাগাদ অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে পৌঁছে যান দেবেন মাহাতো সরকারি হাসপাতাল (সদর) ও মেডিক্যাল কলেজে। প্যাথোলজি বিভাগে গিয়ে দেখেন, মাত্র একজন টেকনিশিয়ান উপস্থিত। অথচ নিয়মমতো সেখানে টেকনিশিয়ানের সংখ্যা ছয়। চিকিৎসক রয়েছেন দু’জন। দেখা যায়, দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগীরা নানান পরীক্ষার জন্য ওই টেকনিশিয়ানকে কাগজ জমা দিলেও চিকিৎসকের সংখ্যা এত কম থাকায় তিনি রোগীদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এই ছবি দেখে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন জেলাশাসক রাহুল মজুমদার।
সরকারি হাসপাতালের এমন অনিয়মের ছবি চোখের সামনে দেখে তিনি নিজের মোবাইলে ভিডিও রেকর্ডিং করেন। তা দেখে ঘাবড়ে যান ওই টেকনিশিয়ান। জেলাশাসক তাঁর কাছে জানতে চান, জেলার আরেক প্রান্ত বান্দোয়ান থেকে কোনও রোগী এখন রক্ত পরীক্ষা করতে এলে তাঁকে কি ফিরিয়ে দেবেন? ওই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে পারেননি টেকনিশিয়ান। সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অনিল দত্ত ও এই মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ পীতবরণ চক্রবর্তীর।
ততক্ষণে এই প্যাথোলজি বিভাগে থাকা অন্যান্য টেকনিশিয়ান ও এক চিকিৎসক পৌঁছে গিয়েছেন হাসপাতালে। স্বয়ং জেলাশাসককে দেখে তাঁরা হকচকিয়ে যান। কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। জেলাশাসকও বুঝতে পারেন, নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখানোর ঘটনা এই সরকারি হাসপাতালে নিয়মিত ঘটেই চলেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট তলব করে জেলাশাসক জানতে চান, ২০১৫ সালের আদেশনামায় প্যাথোলজি কতক্ষণ খোলা রাখার কথা বলা হয়েছে? একজন জানান, বেলা বারোটা। আরেকজনের উত্তর, বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা রাখতে হয়। এসব শুনে রীতিমত আকাশ থেকে পড়েন জেলাশাসক রাহুল মজুমদার। ডিউটি আওয়ার্স কতক্ষণ, সেটাই ঠিকমতো জানেন না স্বাস্থ্যকর্মী থেকে চিকিৎসকও – কেউ!
প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে জেলাশাসক নিজেই জানিয়ে দেন, সকাল ন’টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এই প্যাথোলজি খোলা থাকবে। জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ও অধ্যক্ষের সামনেই চিকিৎসক জানতে চান, তাহলে কি রাত আটটা পর্যন্ত রক্ত সংগ্রহ করতে হবে? মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জানিয়ে দেন, সেটাই বিধি। তখন জেলাশাসক বলেন, এমন গাফিলতি চললে তিনি ভিডিও রেকর্ডিং করে স্বাস্থ্যভবনে পাঠিয়ে দেবেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে অধ্যক্ষও জানতে চান, অন্যান্য টেকনিশিয়ানরা সব গেল কোথায়? অর্থাৎ তিনিও ঠিকমতো জানেন না যে হাসপাতালে কে, কখন উপস্থিত থাকছেন, কে ছুটি নিচ্ছেন।
পুরুলিয়া শহর এবং সংলগ্ন অঞ্চলের একমাত্র বড় সরকারি হাসপাতালের এই চিত্র দেখে জেলাশাসক বলেন, “এই ঘটনায় আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট চেয়েছি। বুধবার এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ-সহ জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে বৈঠকে ডেকেছি।” এই হাসপাতালের প্যাথোলজি বিভাগে ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না, দীর্ঘদিন ধরে জেলাশাসকের কাছে এই সংক্রান্ত নানা অভিযোগ আসছিল। মূল অভিযোগ, প্যাথোলজির চিকিৎসক চিরঞ্জীব মুখোপাধ্যায় বিধি অনুযায়ী হাসপাতালে ঠিকমতো কাজ না করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। এনিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে, ওই চিকিৎসক বলেন, “আমি এই বিষয়ে কিছু বলব না। যা বলার বিভাগীয় স্তরেই জানাব।” সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতেই এদিন আচমকা হাসপাতালের ওই প্যাথোলজি বিভাগে হানা দিয়েছেন জেলাশাসক। এবং স্বচক্ষেই সবটা দেখলেন।
ছবি: সুনীতা সিং।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.