সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: রমাইগড়া, অকরবাঁধ, হলুদবনি, গুড়ুর, হেরবনা- তালিকা অনেক বড়। বনমহল পুরুলিয়া জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আদিম জনজাতি শবরদের ১৬৪টি টোলা। কোনওটা জঙ্গলের কাছে।কোনওটা আবার একেবারে ফাঁকা জায়গায় সাধারণ জনবসতি থেকে অনেকটাই দূরে। টানা প্রায় তিরিশ দিনের লকডাউনে এরা সকলেই উপার্জনহীন। কিন্তু তা সত্ত্বেও টোলাতে ভরদুপুরে মিলছে ধোঁওয়া ওঠা ভাতের গন্ধ।
বাবুই ঘাসের দড়ি, বাঁশের কঞ্চি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উঠোনের একপাশে উনুনে সেদ্ধ হচ্ছে চাল। প্রশ্ন ছিল, চাল–ডাল আছে তো? খাবারের কোন সমস্যা নেই তো? প্রশ্নকর্তা জেলাশাসককে একেবারে দুয়ার থেকে উঠোনে নিয়ে গিয়ে শবর মহিলা বললেন, “ওই দেখ, ভাত ফুটছে।” সেই উনুনের পাশেই খালি গায়ে থালা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তিন শবর বালক। ভাতের হাড়ি নামলেই এই উঠোনেই টালির আচ্ছাদনে খেতে বসবে ওরা!একদিকে গনবন্টনের রেশন। সেইসঙ্গে মিড-ডে মিলের চাল, আলু। তারপর আবার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে
সহায়তা। সেইসঙ্গে পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ত্রাণ তো রয়েইছে। ফলে উপার্জনহীন হয়েও এই লকডাউনে
চিন্তা নেই ভানুমতি শবর, বুদ্ধেশ্বর শবরদের। কিন্তু মন খারাপ একটাই কারণে। শিকারে যেতে পারছেন না তাঁরা।
আসলে প্রকৃতিগতভাবেই বাংলার এই আদিম জনজাতিরা প্রায়শই শিকারে গিয়ে ইঁদুর, খরগোশ ধরে আনেন। তা পুড়িয়ে চলে মহাভোজ! কিন্তু এই লকডাউনে জঙ্গল জুড়ে বনকর্মীদের টহলে এখন সেসব বন্ধ। তাই মনমরা তাঁরা। বান্দোয়ানের গুড়ুর গ্রামের বুদ্ধেশ্বর শবরকে জেলাশাসক রাহুল মজুমদার জিজ্ঞেস করছিলেন ঘরে খাবারের কোনও অভাব নেই তো? স্কুলের বাচ্চাদের মিড ডে মিলের চাল-আলু দিয়ে গিয়েছে তো? ঘরের দরজার দিকে হাত তুলে দেখালেন বুদ্ধেশ্বর। চালের বস্তা ও তার পাশে মেঝেতে থাকা প্রায় চার-পাঁচ কেজি আলু দেখে খানিকটা স্বস্তি পেলেন তিনি। দরজা থেকে উঠোনে নেমে অন্য টোলায় পা রাখতে হাঁটা দিয়েছেন তখনই বুদ্ধেশ্বরের প্রশ্ন শিকারে কখন যেতে পারব? হেসেই ফেললেন জেলার প্রশাসনিক কর্তা। করোনায় যে থমকে গিয়েছে এই আদিম জনজাতির স্বাভাবিক জীবন। গৃহবন্দি হয়ে, মুখে কাপড় বেঁধে, হাত ধুয়ে এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়ছেন গৌরী, বিন্দুবালারা। দিনশেষে প্রশাসন তথা সরকারের কাছে এটাই বড় পাওনা।
তবে চাল, ডাল, আলু দিয়ে থেমে নেই প্রশাসনের টিম। অভাব ঘুঁচিয়ে হাতে অর্থ দিতে টোলায় টোলায় শিবির
করছে। সেই শিবিরেই জাতিগত শংসাপত্র দিয়ে ষাট বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জয়বাংলা পেনশন প্রকল্পের আওতায় আনছেন বিডিওরা। লকডাউনে দু’বেলা থালা ভরতি ভাতের নিশ্চয়তা দিতে এ যেন আরেক লড়াই।
ছবি: সুনীতা সিং
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.