সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: মা ভবতারিণী থেকে আদ্যাশক্তি কালী বা তারা মা- রাজ্যের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কালীক্ষেত্রগুলিতে কীভাবে আচার মানা হল? কেন লাখো লাখো ভক্ত সেখানে পৌঁছে যান তা নিয়েই এই প্রতিবেদন।
দক্ষিণেশ্বর- ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের স্মৃতি বিজড়িত দক্ষিণেশ্বরে পুজো ঘিরে ছিল হরেক আয়োজন। কালীপুজোয় মায়ের অন্নভোগে হিসাবে দেওয়া হয় ভাত ও ঘি-ভাত। সঙ্গে পাঁচ রকমের তরকারি, ভাজা ও পাঁচ রকমের মাছ। পরিচিত সবজি দিয়ে ভাজা ও তরকারি হয়। কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই। পোনা, পার্শে, কই, চিংড়ি, রুই, কাতলা— যে রকম পাওয়া যাবে বাজারে সেরকমই। এর সঙ্গে থাকবে চাটনি, পরমান্ন (পায়েস) ও পাঁচ রকমের মিষ্টি। বিকালে ‘বৈকালিক’-এ দেওয়া হয় হরেক রকমের ফল। মন্দিরের রান্নার দায়িত্বে রয়েছেন নিরঞ্জন মিশ্র। গত ২৫ বছর ধরে তিনি দক্ষিণেশ্বরে মায়ের রান্নায় নিয়োজিত। এক সময়ে বলি হত দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে। বহুকাল হল বলি বন্ধ। মাংস থাকে না মায়ের খাদ্যতালিকায়।
[যে রূপে বাংলায় পূজিতা কালী তা কার ভাবনায় তৈরি জানেন?]
তারাপীঠ- কালীপুজোতে মাকে দেওয়া হয়েছে রাজকীয় ভোগ। সকালে একপ্রস্থ অন্নভোগ। সেখানে দেওয়া হয় পোলাও, খিচুড়ি এবং সাদা অন্ন। সঙ্গে থাকে পাঁচ রকম ভাজা, তিন রকম তরকারি। চারাপোনা, কাতলা, রুই-সহ বিভিন্ন মাছের ভোগ থাকে। তান্ত্রিক মতে নিবেদিত বলির পাঁঠার মাংস, কারণবারি সহযোগে নিবেদিত হয়। আর থাকে পায়েস, চাটনি, দই, আর পাঁচ রকম মিষ্টি। রাতে খিচুড়িই প্রাধান্য পায়। চাল-ডাল মিলিয়ে প্রায় দেড় কুইন্টাল, ১০টি বড় হাঁড়িতে রান্না হয়। করলা, বেগুন, আলু, এমন পাঁচ রকম সবজির ভাজা, তরকারি, শোল মাছ পোড়া, ও বলি-দেওয়া পাঁঠার মাংস। সঙ্গে পাত্রে থাকে কারণবারি। মন্দির কর্তৃপক্ষ যেমন ভোগ নিবেদন করেন, তেমনই ভক্তেরাও তাঁদের ইচ্ছেমতো সবজি,মাছ, মাংসের ভোগ নিবেদন করেন তারা মাকে।
তারাপীঠ মন্দিরের ভোগ রান্না করছেন বংশপরম্পরায় ময়ূরেশ্বর থানার দক্ষিণগ্রামের কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের সঙ্গে থাকেন তারাপীঠের মন্দিরের সদস্যরা। কালীপুজোর ভোগের রান্না করেন এঁরা জনা পনেরো ব্যক্তি। ভোর থেকে দুপুরের ভোগ রান্না শুরু হয়, আর দুপুরের পরেই শুরু রাতের ভোগের রান্না। ভোগগৃহ, নাটমন্দিরে বসে প্রসাদ খান সহস্রাধিক ভক্ত। আরও অনেক প্রসাদ নিয়ে বাড়িতে গিয়ে খান।
কালীঘাট – এই শক্তিপীঠে নিত্য কালীপুজোর সঙ্গে লক্ষ্মীপুজোও করা হয়। নিত্যপুজোর ভোগে নানা পদের কোনও হেরফের হয় না। শুধু পরিমাণে বেশি ভোগ দেওয়া হয়। পুজোর দিন যে পালাদার ভোগের দায়িত্বে থাকেন, সব খরচ তাঁর উপরেই বর্তায়। কালীঘাট মন্দিরে প্রায় ৬০০ সেবায়েত রয়েছেন। কালীপুজোর দিন দায়িত্বপ্রাপ্ত পালাদার-সহ আরও প্রায় শ’দেড়েক সেবায়েত ভোগ দেন। অমাবস্যা তিথি শুরু হওয়ার আগে মা কালীকে একপ্রস্থ ভোগ দেওয়া হয়। তাতে থাকে শুক্তো, পাঁচ রকমের ভাজা (আলু, বেগুন, পটল, উচ্ছে অথবা করলা, ও কাঁচকলা), পোলাও, তিন রকম মাছের পদ (রুই, ইলিশ, চিংড়ি), কচি পাঠার মাংস, চাটনি (খেজুর-আমসত্ত্ব-আনারস) ও পায়েস, পান ও জল।
আদ্যাপীঠ – দক্ষিণেশ্বর লাগোয়া এই কালীক্ষেত্র নিয়ে রয়েছে নানা ইতিহাস। চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় কবিরাজি পড়তে এসেছেন অন্নদা ঠাকুর। কবিরাজি পাশ করার প্র্যাকটিস করবেন এমন ঠিক করেছেন। এমন সময় রামকৃষ্ণদেব তাঁকে বলেছিলেন তোমার কবিরাজি ব্যবসা হবে না। ঠাকুর অন্নদাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ইডেন গার্ডেন্সের ঝিলে আদ্যা মা পড়ে আছেন। ওখান থেকে মাকে উঠিয়ে নিয়ে এসো। অন্নদা ঠাকুর ঝিলে খোঁজাখুঁজি করতে ১৮ ইঞ্চি আদ্যা মায়ের কষ্টিপাথরের মূর্তি পান। সেদিন ছিল রামনবমী তিথি। রাতে মা তাঁকে দেখা দিয়ে বলেন, অন্নদা কাল বিজয়া দশমী। তুমি আমায় গঙ্গায় বিসর্জন দিও। এই কথা শুনে অন্নদা আঁতকে উঠে বলেন, আমি কি পুজোপাঠ করিনি বলে তিনি রাগ করে চলে যাচ্ছেন? তখন মা বলেন, না তা নয়। আমি শুধু শাস্ত্র বিহিত মতে পুজো পেতে চাই তা নয়। মা খাও, মা পড়ো- এমন সহজ সরল প্রাণের ভাষায় যে ভক্ত নিজের ভোগ্যবস্তু এবং ব্যবহার্য বস্তু আমাকে নিবেদন করেন, সেটাই আমার পুজো। যদি কোনও ভক্ত আমার সামনে আদ্যাস্তোত্র পাঠ করে তাহলে আমি বিশেষ আনন্দিত হই। এরপর মা আদ্যাস্তোস্ত্র বলেন, আর অন্নদা ঠাকুর লিখে যান। সেই স্ত্রোত্রই এখন আদ্যাপীঠে পাঠ হয়। এই ঘটনার চার বছর পর ১৯১৮ সালে ঝুলন পূর্ণিমার রাতে রামকৃষ্ণদেব অন্নদা ঠাকুরকে হৃষিকেষ যেতে বলেন। সেখানে মন্দির তৈরির আদেশ দেন তিনি। রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন সৃষ্টির পর পৃথিবীর বুকে এমন মন্দির হতে চলেছে যেখানে ঈশ্বরের প্রকট আবির্ভাব ঘটবে। তার মাহাত্ম্য এতটাই হবে যে মন্দির স্পর্শ করলেই ভক্তদের উদ্ধার মিলবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.